নারায়ণ দে, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গত একবছর ধরে ভারত-কানাডা কূটনীতিক সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছে, গত কয়েক দিনে তা চরম আকার নিয়েছে। দুই দেশই একে অপরের কূটনীতিকদের বহিষ্কারের ঘোষণা করেছে। কানাডার অভিযোগ, ভারত নিযুক্ত এজেন্টরা কানাডার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কী নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত? ভোটে বাড়তি সুবিধা পেতেই কি ভারত বিরোধিতার সুর চরমে কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রীর?
উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা। ভারত থেকে প্রায় বারো হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দেশই এখন ভারতের তরুণদের সিংহভাগের গন্তব্য। আকার ও অর্থনীতিতে ভারতকে টেক্কা দেয় কানাডা। কিন্তু জনসংখ্যার নিরিখে অনেক পিছিয়ে। যে কারণে ভিনদেশীদের নাগরিকত্ব পেতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। এই নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়েই গতবছর শুরু হয়েছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন। মূলত একটি হত্যাকাণ্ডকে ঘিরেই সমস্যার সূত্রপাত। খলিস্তানি টাইগার ফোর্স নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর। তার শেষ ঠিকানা ছিল কানাডা। কানাডার নাগরিকত্বও পেয়েছিল সে। গতবছর জুন মাসে ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রভিন্সে খুন করা হয় তাকে। ওই ঘটনার পর কানাডিয়ান সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দাবি করেছিলেন, কানাডার নাগরিককে খুনের ঘটনায় যুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার। কিন্ত দাবির স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি কানাডা। যদিও ওই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ৪ জন ভারতীয়কে গ্রেফতার করেছে কানাডা পুলিশ।
চলতি মাসে ফের সরব হয় কানাডা। প্রমাণ রয়েছে, এমন দাবি করে আরও বেশ কয়েকটি অভিযোগ তোলা হয়। যেমন, কানাডাবাসীদের নজরবন্দী করছে ভারত। লরেন্স বিষ্ণোইয়ের মতো গ্যাংস্টারদের মদতে কানাডিয়ানদের খুন করা। সর্বোপরি, কানাডার গণতন্ত্রে আঘাত হানছে ভারত। সাংবাদিক সম্মেলন করেন জাস্টিন ট্রুডো। তিনি বলেন, ফেডারেল রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ বা আরসিএমপি স্পষ্ট ও শক্তিশালী প্রমাণ পেয়েছে যে ভারতীয় সরকারি এজেন্টরা জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ কাজ করে চলেছে। এরপর আরসিএমপি পৃথকভাবে জানায়, যাবতীয় প্রমাণ সরাসরি ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। সহিংসতা রোধে তদন্তে সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে। এরপরই কানাডা পররাষ্ট্রমন্ত্রক ভারতীয় হাইকমিশনার সঞ্জয়কুমার বর্মা-সহ ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে। এই সিদ্ধান্ত অনেক বিবেচনার পরেই নেওয়া হয়েছে বলে জানান কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জলি। এরপর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, তদন্তের অজুহাতে রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে জানানো হয়, কানাডা তাদের অভিযোগের নিরিখে একটিও প্রমাণ এখনও দিতে পারেনি। ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তেরও নিন্দা করা হয়। জবাবে ভারত সরকারও ৬ কানাডিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। একইসঙ্গে কানাডার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে পশ্চিমা দেশগুলিকে আবেদন করে ভারত সরকার। স্বাভাবিকভাবেই ক্রমশ তলানিতে পৌঁছচ্ছে ভারত-কানাডা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।
আশির দশকে পঞ্জাবে মাথাচাড়া দিয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী খলিস্তানি আন্দোলন। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তা কড়া হাতে দমন করেছিল। কিন্তু সেইসময় শিখ সম্প্রদায়ের বহু মানুষ ভারত ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সিংহভাগই আশ্রয় নিয়েছিল কানাডায়। সেসময় কর্মী সমস্যায় জেরবার কানাডাও তাদের সাদরে গ্রহণ করেছিল। তারপর কানাডার অর্থনৈতিক উত্থানে সামিল হয়েছিল ভারতীয় শিখদের একাংশ। পরবর্তীতে তারা সকলেই কানাডার নাগরিকত্ব পান। শুধু কী তাই, শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ সে দেশে রাজনৈতিক দলও গড়ে তোলে।বছর ঘুরতেই কানাডায় নির্বাচন। পঞ্জাবের পর কানাডাতেই সবচেয়ে বেশি শিখের বাস। যদিও সংখ্যায় তারা কানাডার জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ। কিন্তু এই দুই শতাংশ শিখই কানাডার ঘরোয়া রাজনীতিতে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৩৪০ আসন বিশিষ্ট কানাডার সংসদে ট্রুডোর লিবারেল পার্টির দখলে আছে ১৬০ আসন, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে ১০টি কম। সে দেশের সংসদের ৩৪০ আসনের ২০টির ভাগ্য নির্ধারিত হয় এশিয়দের ভোটে। তারমধ্যে ১৯টি-তে শেষ কথা শিখরা। ট্রুডো এই ১৯টি আসনকে পাখির চোখ করেছেন। আর তাঁর দেশের শিখদের সিংহভাগই খলিস্তানপন্থী এবং তারা প্রেরণা ও অর্থ জুগিয়ে ভারতীয় শিখদের ফের অস্ত্র হাতে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে উসকানি দিচ্ছে। স্বভাবতই কানাডায় শিখদের নাগরিকত্ব এবং প্রতিষ্ঠা পাওয়া তুলনায় অনেক সহজ। নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ট্রুডোর বিচলিত হওয়ার পিছনে নির্বাচনী সমীকরণটিই আসল বলে সে দেশের রাজনৈতিক মহল ও মিডিয়ার একাংশের দাবি। যে কারণে কানাডার একাধিক বিরোধী দলও ট্রুডে়ার রাজনৈতিক স্বার্থে বিদেশ নীতি পরিবর্তন এবং ভারতের মতো বৃহৎ গণতন্ত্রের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়া নিয়ে আপত্তি তুলেছে।