মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেবীপক্ষের সূচনায় মেতেছে বঙ্গবাসী। একদিকে যখন দেবীরূপী মেয়ের আগমন হচ্ছে, দেবীর হাতে অসুর দমন হচ্ছে, তখন অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ঘরের মেয়েরা। আরজিকর ধর্ষণ ও খুনকাণ্ডে উত্তাল গোটা বাংলা। পথে নেমেছেন বিভিন্ন স্তরের মানুষজন। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর পাশাপাশি বিনোদন জগৎ, প্রযুক্তিবিদ ও নাগরিক সমাজ। এই বিশাল জনগর্জনের পরও থামছে না ধর্ষণ প্রবণতা।
শুক্রবারই নাবালিকা ধর্ষণের ঘটনায় তুলকালাম হয়েছে নিউটাউনে। উত্তেজিত জনতা অভিযুক্তর বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশকে ঘিরেও বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। তারপর অভিযুক্তকে আটক করে পুলিশ। নির্যাতিতার মায়ের অভিযোগ ভোরবেলায়ই তাঁরা কাজে চলে যান। মেয়ে ঘরে একা থাকে। সেই সুযোগ নিয়ে নাবালিকাকে জোর করে শারীরিক নির্যাতন চালায় অভিযুক্ত। এখানেই শেষ নয়, কাউকে বললে অ্যাসিড দিয়ে মুখ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন নির্যাতিতার মা।
নিউটাউনের পাশাপাশি নাবালিকা ধর্ষণের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে জয়নগর। একটি দশ বছরের নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ উত্তাল হয়েছে এলাকা। নাবালিকাকে খুন করে দেহটি খালে ফেলে দেয় দুষ্কৃতীরা। শুক্রবার টিউশনে গিয়ে আর ফেরেনি নাবালিকা। শনিবার সকালে বাড়ি থেকে ৫০০মিটার দূরে একটি জলাজমিতে নাবালিকার দেহটি উদ্ধার করা হয়। নাবালিকার সারা দেহে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। ওই নৃশংস ঘটনায় পরিবার কুলতলির মহিষমারী পুলিশ ফাঁড়িতে অভিযোগ জানাতে গেলেও অভিযোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। তার পাশাপাশি পরিবারের সদস্য়দের হেনস্থারও অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদে জয়নগর কুলতলি রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা। জয়নগর থানার পুলিশ থাকা সত্বেও এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল প্রশ্ন তুলেছেন গ্রামবাসীরা। পুলিশকে ঘিরে লাঠি ঝাঁটা হাতে সোচ্চার হন তাঁরা। যদিও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।পরে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কুলতলির ঘটনায় সরব হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। নাবালিকার দেহ ঘিরে পদ্মেরহাট হসপিটালের সামনে বিক্ষোভ চলে বামেদের। ডিওয়াইএফআইয়ের রাজ্য় সম্পাদক মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চলে বিক্ষোভ।
অন্যদিকে, আসানসোলে প্রতিবাদ মিছিল করে বিজেপি। আসানসোলের বার্নপুর রোডের ডলি লজ থেকে কালো গেঞ্জি পরে মিছিলে পা মেলান বিজেপি নেতৃত্ব। বাংলা নিজের মেয়ের বিচার চায় লেখা গেঞ্জি পরে মিছিল করেন তাঁরা।ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই নির্যাতিতার পোশাক, রাতে বেরিয়েছেন কেন, এইধরণের প্রশ্ন হামেশাই ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রে অর্থাৎ নাবালিকাকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে কী বলবেন তাঁরা?
১০ বছর আগে ২০১৪ সালের স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, মা বাবা তো মেয়েকে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন করেন। তারা কি নিজের ছেলেদের প্রশ্ন করেন, যে ছেলে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, মা বাবা সেই প্রশ্ন করলে ধর্ষণের ঘটনায় অনেকাংশে রাশ টানা যাবে।অনেক ধর্ষণকাণ্ডে মহিলার ছোট পোশাক নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। যুক্তির খাতিরে যদি তা মেনে নেওয়া হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠে, শিশু বা নাবালিকাকে কেন ধর্ষণ করা হয় ? বয়স্ক মহিলা, মানসিক বিপর্যস্তদের কেন ধর্ষণ করা হয় ? শাড়়ি ও বুরখা পরা মহিলাদের কেন ধর্ষণ করা হয় ? রাজস্থান-উত্তরপ্রদেশের বহু গ্রামে তো মহিলারা ছোট পোশাক পরেন না। তবে সেখানে কেন ধর্ষণ হয় ?
অক্ষরা সেন্টার নামে একটি এনজিও ৮টি শহরে সমীক্ষা চালিয়েছিল। ৩হাজার মহিলা ও পুরুষের মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে উঠে এসেছে ৫৪.৮ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, মহিলাদের ছোট পোশাক পরার কারণে ধর্ষণ হয়। অন্যদিকে ৩৯.২ শতাংশ মহিলাও এমনটাই বিশ্বাস করেন। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। একাধিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ধর্ষকদের ৩টি ভাগে ভাগ করা যায়।পাওয়ার রেপিস্ট- এধরণের ধর্ষক যৌন নির্যাতন করে নিজেকে প্রভাবশালী মনে করে।অ্যাংগার রেপিস্ট- এদের মধ্যে প্রচুর রাগ থাকে। যারা মা বোন তুলে নির্যাতিতাকে গালিগালাজ করে। নির্যাতিতা বাধা দিতে গেলে তাকে খুনও করতে পারে।সেডিস্টিক রেপিস্ট- এরা অন্যকে শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করে আনন্দ অনুভব করে। এরা নির্যাতিতাকে দীর্ঘসময় ধরে শারীরিক নিগ্রহ করে।
ধর্ষকদের অনেকেই মানসিক অসুস্থ বলে থাকেন।
কেন এমন ধরণের মানসিক সমস্যা হয় ?
২৬৯ জন অপরাধীর মধ্যে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল ১৩৭জন ধর্ষক ও ১৩২জন শিশুর যৌন নির্যাতনে অভিযুক্ত। এদের মধ্যে ৭৩ শতাংশের ছেলেবেলাতেই যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ৭৮ শতাংশ ছোট থেকেই মা-বাবার সম্পর্কে হিংসা দেখে বড় হয়েছে। ৭০ শতাংশ মানসিক অপব্যবহারের শিকার। এছাড়া শিশুদের মধ্যে পশুপাখিদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, ছোট থেকে হিংসাত্মক ছবি দেখার মতো কিছু দেখতে এখন থেকেই সাবধান হয়ে যান।সবমিলিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতারের দাবি তো তুলছেই হবে, কিন্তু ধর্ষণ যাতে না হয়, সেজন্য ছোট থেকেই শিশুর মানসিক বিকাশে জোর দিতে হবে।