পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ যদি বন্ধু হও, যদি বাড়াও হাত… কথা দিলাম, সুখে-দুখে পাশে থাকব দিনরাত। সত্যিই কী আছে এমন বন্ধুত্ব এই স্মার্টফোনের যুগে ? এই ওয়ান টাচে ফ্রেন্ড, আনফ্রেন্ড ও ফ্রেন্ডজোন করে দেওয়ার যুগে ? হ্যাঁ এখনও বেঁচে আছে এমন বন্ধুত্ব। তা মেলে এক অন্যরকম মেলায়। মেলাজুড়েই চলে বন্ধু খোঁজার পালা। এখানে বন্ধু খোঁজা হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। সর্বপরি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। কোথায় সেই মেলা জানেন ? বর্ধমানের সরঙ্গা গ্রামে। এখানে ১৫০ বছর ধরেও অম্লান এমন মিষ্টি বন্ধুত্ব। এটাই এই মেলার আকর্ষণ। সাধারণের কাছে এই মেলা বন্ধু খোঁজার মেলা বা ‘সহেলা মেলা’ বলে পরিচিত। বর্তমানে এই মেলা লোকমুখে সয়লা মেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। পান-সুপারি-শোলার মালায় সইকে বরণ করে নেওয়া হয় এখানে।
দামোদর এবং দ্বারকেশ্বর নদের অববাহিকায় এই মেলার আয়োজন করা হয়। এই রীতি পালিত হয় বাঁকুড়ার ইন্দাস, বর্ধমানের খণ্ডঘোষের বিভিন্ন এলাকায়। এক যুগ বা ১২ বছরের মাথায় ফিরে আসে এই মেলা। এবার হচ্ছে সরঙ্গা গ্রামে। এলাকার বাসিন্দাদের কথায়, যুগ যুগ ধরে এই মেলা চলে আসছে। ইংরেজি ১৩০০ সাল থেকে এই মেলা হয়ে আসছে।
সময়ের সঙ্গে বদলেছে বন্ধুত্বের ধরন। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এক ক্লিকেই কেউ হয়ে যায় ‘ফ্রেন্ড’ আবার কেউ ‘আনফ্রেন্ড’। কিন্তু গতিময় জীবনেও একঘেঁয়েমি ও খরা কাটাতে পারে এক পশলা বৃষ্টির মতো নির্ভেজাল বন্ধুত্ব। যা চারকোনা স্ক্রিনের বাইরের জগত ছেড়ে মিশিয়ে দেয় ৮ থেকে ৮০ কে।
সাধারণত প্রতি ৫ বছর অন্তর কার্তিক মাসের পূর্ণিমাতে মনসা পুজোর মাধ্যমে ইন্দাসের আকুই গ্রামের মানুষ যোগ দেন সই পাতানোর মেলায়। তবে এবার ছ’বছর পর হয়েছে এই অনুষ্ঠান। সেকারণেই এখন আকুইয়ের প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয় স্বজনদের ভিড়, এমনকি দূর দূরান্ত থেকেও অসংখ্য মানুষ এই গ্রামে হাজির হয়েছেন এই আয়োজনে অংশ নিতে। এখানে পুরুষের সঙ্গে পুরুষ ও নারীর সঙ্গে নারীর বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। এখানে রাম রহিমের একে অপরের গলায় মালা পরিয়ে বাড়িয়ে দেয় বন্ধুত্বের হাত। মুছে দেয় সব ভেদাভেদ। এটাই এই উৎসবের অন্যতম প্রাচীন রীতি। বর্তমান এই অস্থির সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য এক নজির হতে পারে আকুইয়ের এই সয়লা উৎসব।
সয়লার অন্যতম অঙ্গ ‘গোয়া চালানো’। গোয়া হলো সয়লার ঝাঁপি। এই ঝাঁপির মধ্যে দই, পঞ্চ শস্য, গোটা হলুদ, সিঁদুর, খই, গোটা সুপারি, পান বাতাসা রাখা থাকে। স্থানীয় চণ্ডী মন্দিরে পুজো দিয়ে পরস্পরের বাড়িতে এই ঝাঁপি নিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপন করা হয়। শোলার মালা পরিয়ে, দইয়ের ফোঁটা দিয়ে, ‘উপরে খই নিচে দই, আমি তোমার চিরকালের সই’ লাইন দুটি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের সূচনা হয়। হাতে হাত রেখে সই পাতানো হয়। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে, সব সময়ে একে অপরের পাশে থাকার।
ডিজিটাল যুগে বন্ধু খুঁজতে মাঠে জমায়েত করতে হয়না। এ উৎসব তারপরও বহাল তবিয়তে নিজস্ব মহিমায় অটুট। আজও বাংলার এই বন্ধু খোঁজার উৎসব বা সহেলা মেলায় নারী পুরুষের ঢল নামে। ডিজিটাল দুনিয়া সব প্রাচীন ভাবনাকে যে গিলে খেতে যে পারেনি তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে এই সহেলা মেলায়। অনেকে পুরনো বন্ধুকেই সই পাতিয়ে ঝালিয়ে নেন বন্ধুত্ব।