পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ আষাঢ়ে গল্পই বলুন কিংবা সাদা হাতি। গলার কাঁটাই বলুন কিংবা আর্থিক ব্ল্যাকহোল। এই সব উপমাই যার ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় বাংলাদেশের এমন এক প্রজেক্টের নাম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। কিন্তু এমনটা কেন বলছি, তার জন্য লাভ-ক্ষতির অঙ্কটা একটু বুঝে নিতে হবে।
ওপার বাংলার বিজ্ঞানীদের ইচ্ছেডানায় ভর করে ২০১৮ সালের ১২ মে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধ স্যাটেলাইট ওয়ান। যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহটির মধ্য দিয়ে ৫৭ তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের ক্লাবে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। এই প্রকল্পটি তৎকালীন ডাক ও টেলি-যোগাযোগ বিভাগের অধীন বাংলাদেশ টেলি-যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় এবং এটি ফ্যালকন ৯ ব্লক ৫ রকেটের প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের সেই স্বপ্ন উড়ান যত দিন যাচ্ছে, দুঃস্বপ্নে পরিনত হচ্ছে। মহাকাশে থেকেও তা বাড়িয়ে চলেছে পদ্মাপাড়ের বাসিন্দাদের জন্য ঋণের বোঝা। ঠিক কী কী কারণে এই সফল উৎক্ষেপণ ব্যর্থতার অতল গভীরে নিমজ্জিত হচ্ছে, এর আসল উত্তর এক-কথায় সঠিক পরিকল্পনার অভাব। যার ফলস্বরূপ এই প্রোজেক্টে আয়ের চেয়ে ব্যায়ই বেশি হয়েছে।
হিসেব বলছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- ১
মেয়াদ শেষে আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১,১৮৮ কোটি টাকা
প্রকল্পে মোট ব্যয়ের পরিমাণ হচ্ছে ২,৭৬৫ কোটি টাকা
মেয়াদ শেষে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১,৫৭৭ কোটি টাকা
২০১৮ সালে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়। তবে নকশার কারণে পরিষেবা দিতে একাধিক জটিলতার সম্মুখীন হয় এই স্যাটেলাইটটি। উৎক্ষেপণের আগেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্রিকোয়েন্সি সমন্বয় করা দরকার ছিল। অথচ তা করাই হয়নি। এখনও পর্যন্ত নিরীক্ষার আওতায় আসা কোনও অর্থবছরেই লাভ করতে পারেনি বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড বা BSCL।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পরিকল্পনা কমিশনের কিছু আপত্তি সত্ত্বেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন করেন, যার খরচ পরে কমে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায় এসে দাঁড়ায়।
এর মধ্যে এই প্রকল্পে সরকার দিয়েছে ১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা এবং এইচএসবিসি ব্যাংকের কাছ থেকে ১২ বছর মেয়াদে প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন ইউরো ঋণ নিয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে যখন এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়, তখন ১৫৫ মিলিয়ন ইউরোর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত স্যাটেলাইট পরিচালনার জন্য গঠিত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এক পয়সাও জমা দিতে পারেনি।
২০১৮ সালে স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা স্যাটেলাইটের জন্য প্রতি ছয় মাসে এইচএসবিসিকে প্রায় ৮৫ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হয় বাংলাদেশ টেলি-যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসিকে।
এপ্রিল পর্যন্ত সুদসহ ১২টি কিস্তিতে এইচএসবিসিকে ১০১ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ২০২৮ সালের এপ্রিলের মধ্যে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ডলারের আরও আটটি কিস্তি পরিশোধ করতে হবে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার ৪০ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার কারণে বিটিআরসির ওপর ঋণ পরিশোধের বোঝা আরও জেঁকে বসেছে। এখন বিটিআরসিকে প্রতি বছর দুই কিস্তিতে ১৯০ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়।
স্যাটেলাইটটির আয়ুষ্কাল ১৫ বছর—অর্থাৎ ২০৩৩ সালের পর এর অস্তিত্বই থাকবে না। তাই প্রকল্পের খরচ পুনরুদ্ধারের সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের কারণে সরকারের দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হতে চলেছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর সেদিন সফল উৎক্ষেপণ হলেও কোনও বিজ্ঞানী বা গবেষক সেই প্রকল্পে অবদান রাখার সুযোগই পায়নি। এই প্রকল্পের ফলে বাণিজ্যিকভাবে লাভ হওয়ার বদলে বারবার ক্ষতির মুখেই পড়েছে দেশ। যেহেতু বাংলাদেশের উপগ্রহটি বিদেশি কোম্পানি দ্বারা নির্মিত, তাই বাংলাদেশের জাতীয় তথ্য নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রকল্পটি সম্পন্ন করার পর ২০১৮ সালে নবগঠিত বিএসসিএলের কাছে স্যাটেলাইটটি হস্তান্তর করে বিটিআরসি।
বিটিআরসির ২০২১ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেহেতু এইচএসবিসির সঙ্গে বিটিআরসির মধ্যে ঋণচুক্তি সই হয়েছিল, সেহেতু এই সম্পদের হিসেবও বিটিআরসির কাছেই রাখতে হচ্ছে, যদিও ভবিষ্যতে এ প্রকল্প থেকে কোনো সুফল আসবে না।
এদিকে এই উপগ্রহকে নিয়ে আশা ছিল, স্যাটেলাইটের সক্ষমতা ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, সার্কভুক্ত দেশসমূহ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের কাছে বিক্রি করা যাবে। তবে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সাত বছরেও বাংলাদেশ এসব দেশে বাজার তৈরি করতে পারেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের যা পরিস্থিতি, তাতে একেই আওয়ামী লীগ সরকার কিংবা হাসিনা অথবা বঙ্গবন্ধু নাম নিয়েই রে রে করে উঠছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম দিয়ে তৈরি এই লোকসানমূলক প্রকল্প কিংবা হাসিনা সরকারের আমলে অনুমোদিত এই প্রকল্প কতটা জায়গা পায় সেটাই দেখার। ইতিমধ্যেই এই প্রকল্প থেকে নিস্তার পেতে, আয় বাড়াতে ও ব্যয় কমাতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও উপগ্রহ বিশেষজ্ঞরা।