পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশ। কোটা আন্দোলন। হাসিনার পদত্যাগ। মুজিবের মূর্তি ভাঙচুর। ইউনুসের সরকার। ইসকন নিয়ে তোলপাড়। সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর অত্যাচার। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার। আরও আন্দোলন। আরও রক্ত। আরও হত্যা। অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ। বিক্ষোভ ওপার থেকে এপার বাংলায়। কে সরব, কে নীরব?
পদ্মাপাড়ে অশান্তির আগুন। ওপার বাংলায় যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, তার আঁচ এসে পৌঁছেছে এপার বাংলাতেও। কেন মুখ্যমন্ত্রী চুপ রয়েছেন বুধবারই তা নিয়ে সরব হন বিজেপি নেতৃত্ব। আর তার পরই বৃহস্পতিবার বিধানসভায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খোলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দেশের ব্যাপারে কথা বলার এক্তিয়ার নেই বলে জানালেও, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানালেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “যে ধর্মের উপরই অত্যাচার হোক না কেন, আমরা কখনওই তা মেনে নিতে পারি না।” শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এখানকার ইসকনের প্রধানের সঙ্গে দু’বার টেলিফোনে কথা হয়েছে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী।
এর আগে কংগ্রেস নেত্রী ও সদ্য নির্বাচিত সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরাও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এক্স হ্যাণ্ডেলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি লেখেন, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারি ও “সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপরে ক্রমাগত ঘটে চলা সহিংসতার সংবাদ অত্যন্ত চিন্তাজনক। আমি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করব যাতে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয় এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে জোরালো ভাবে তুলে ধরা হয়।অনেকেই প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে বেশ আশাপ্রদ। তাঁর মধ্যে তাঁর ঠাকুমা তথা ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া দেখতে পান অনেকে। তাঁদের মতে, ইন্দিরা গান্ধী থাকলে বাংলাদেশের কিছু একটি হিল্লে হতো। তবে ইন্দিরা গান্ধী না থাকলেও তাঁর নাতনী প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে আশাবাদী একাংশ।
এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার যদি এই বিষয়টা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্রুত কোনও বিবৃতি প্রকাশ না করে, তবে ভারতের প্রধান শাসকদল অর্থাৎ বিজেপি যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ভারতের হিন্দু সমর্থকের মধ্যে হিন্দু হৃদয়ের সম্রাট বলে দেখানোর যে প্রচেষ্টা করেছে সেটাও ধাক্কা খাবে। ভারত সরকারের প্রতি আস্থা হারাতে পারেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরাও।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে হিন্দুবিদ্বেষী মনোভাব ক্রমেই ইসকনবিরোধী মনোভাবে পরিনত হচ্ছে। ইসকনকে নিষিদ্ধ সংগঠন ঘোষণা করার জন্য বাংলাদেশে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। যদিও তা খারিজ করে আদালত জানিয়ে দেয় এ সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
তবে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলাটি করা হয় শুধুমাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারীকে আটক করার জন্যই নয় বরং, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের আন্দোলনে উঠে আসা ৮ দফা দাবিকে দাবিয়ে দেওয়ার জন্য। এমনই অভিযোগ বারবার সামনে আনছেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা। তাঁরা বলছেন, আন্দোলনে এই ৮ দফা দাবিকে সামনে রাখায় রাজনৈতিক কুৎসার শিকার হচ্ছেন। কখনও তাঁদের বলা হয়েছে এই ৮ দফা দাবি কিছুই নয়। শেখ হাসিনা সরকারকে নাকি তাঁরা ফিরিয়ে আনার জন্যই বাংলাদেশের হিন্দুরা চক্রান্ত করে আন্দোলনের নাটক করছেন। আবার কখনও বলা হয়েছে, এই ৮ দফা দাবি বাংলাদেশের যে সংখ্যালঘু হিন্দুরা সামনে রেখেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সমর্থক। আবার কখনও আরও একটি অদ্ভূত অভিযোগ করে বা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং বলা হয়েছে যাঁরা এই আন্দোলন করছেন, যাঁরা এইসব দাবি সামনে রাখছেন, তাঁরা আসলে সবাই ভারতের দালাল। অথবা ভারতে যে প্রধান শাসকদল রয়েছে বিজেপি, সেই বিজেপির দালাল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের তরফে তোলা ৮ দফা দাবি কী কী? এই দাবিগুলি হল —
১. বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপরে যে নির্যাতন তা বিচার ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে যত দ্রুত সম্ভব দোষীদের চিহ্নিত করতে হবে।
২. দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
৩. ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৪. তাঁদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
৫. যত দ্রুত সম্ভব সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৬. সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে।
৭. দুর্গাপুজোর সময় তাঁদের ৫ দিনের ছুটি দিতে হবে।
৮. বাংলাদেশে অন্যতম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলির সময়ও যথোপযুক্ত ছুটি দিতে হবে।
সবমিলিয়ে রাজনৈতিক ডামাডোলে উত্তপ্ত বাংলাদেশ। সংখ্যালঘুদের কোনঠাসা করার চেষ্টা। সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণের জেরে তেতে উঠছেন এদেশের মানুষ। ভারত-বাংলাদেশের কূটনাতিক সম্পর্কের বদলে যাওয়া সমীকরণের আঁচ পড়েছে দুদেশেই। শেখ হাসিনাকে এদেশে আশ্রয় দিয়ে উপমহাদেশে ভারত তার কূটনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছে আগেই।কোটা সংস্কার আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে ৫ অগাস্ট বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছিল। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে স্লোগান উঠেছিল চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার। তারপর থেকে ৪ মাসে দফায় দফায় ওপার বাংলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে অনেক ঝড়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুস। বন্ধ হয়ে যায় এপার-ওপারের যাতায়াত। মাথার ছাদ হাসিনাকে ছাড়া অস্তিত্বের জন্য লড়ছেন আওয়ামী লীগের সদস্যরা। সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর একের পর এক আক্রমণে বারবারই তেতে উঠেছে ওপার বাংলা।২৫ নভেম্বর বিতর্কের ঝড় আরও গতি বাড়ালো যখন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র তথা পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারীকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের পুলিশ। বাংলাদেশের ৩ কোটি সংখ্যালঘু মানুষ তখন আগের স্লোগানটাকে আর একটু বদলে দিয়ে বলছেন, চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম গ্রেফতার।২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশ করেছিল বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ। সেই সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুও। সেই সমাবেশেই নাকি তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছিলেন। এই অভিযোগেই চট্টগ্রামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন বর্তমানে বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা ফিরোজ খান।
গত ৩১ অক্টোবর চিন্ময় দাস-সহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন সেই নেতা।সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই গত ২৫ নভেম্বর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুকে গ্রেফতার করে ঢাকা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। এরপর তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে অভিযোগ, চিন্ময় প্রভুকে কারাগারে ওষুধ দিতে দেওয়া হয়নি পুলিশের তরফে। ধৃত হিন্দু নেতাকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে হেনস্থা করার অভিযোগও উঠেছে। এদিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের ঘটনার জেরে বাংলাদেশে সংখ্য়ালঘুদের মধ্য়ে শোরগোল পড়ে যায়। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ এই গ্রেফতারির তীব্র নিন্দা করেছে। এদিকে চিন্ময় প্রভুর মুক্তির দাবিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় নেমেছেন কয়েক হাজার হিন্দু। এরই মধ্যে প্রতিবাদী বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে।
২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে বাইরে চিন্ময় প্রভুর গ্রেফতারির প্রতিবাদ জানানো বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে পুলিশ লাঠিচার্জ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে এই সংঘর্ষে এক আইনজীবী খুন হন। বাংলাদেশের হিন্দু সন্ন্যাসীকে জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-৬।লাগাতার অত্যাচারের জেরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া হিন্দুরা যখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, লাগাতার মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভ-ধর্না-অবস্থান শুরু করেছিল আর তাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাস। এই অবস্থায় হঠাৎই তাঁকে গ্রেফতারের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়েছে অশান্তি।ভাঙচুর থেকে অগ্নিসংযোগ, সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে একের পর এক হাড় হিম করা সেইসব ছবি।এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত ইসকনের সেন্টার জোরজবরদস্তি বন্ধ করার কাজ শুরু করে দিয়েছেন মৌলবাদী সংগঠন। ইসকনকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে এই কাজ চলছে। কোথায় গিয়ে থামবে এই জ্বলন্ত ক্ষোভের আগুন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বিশ্ববাসী।