সমাজমাধ্যমে এক পোস্ট ঘিরে এবার তুলকালামকাণ্ড চট্টগ্রামের কোতয়ালি থানা এলাকার হাজারী গলিতে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রণক্ষেত্র পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে। মুহূর্মুহূ রক্তাক্তকাণ্ড ঘটে। ঠিক কী ঘটেছে ৫ নভেম্বর রাতে ? কোথা থেকেই বা ঘটনার সূত্রপাত। আসুন জেনে নেওয়া যাক।
শেখ হাসিনার পদ ও দেশত্যাগ এবং মহম্মদ ইউনুস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যাচ্ছে হিংসার ছবি। ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব থেকেই এই হিংসা ও উত্তেজনা ছড়াচ্ছে বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
এমনই এক হিংসার ঘটনা ঘটে গেল মঙ্গলবার রাতে। অন্ধকারতম রাত কাটাল চট্টগ্রাম। অভিযোগ, সন্ধ্যে ৭ টা নাগাদ আচমকাই হাজারী গলিতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাঁদের লক্ষ্য করে ইটবৃষ্টি করা হয়। এরপর পুলিশ বাহিনীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপও করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। তাতে প্রায় ১২ জন সেনা পুলিশ কর্মী গুরুতর আহত হন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
যদিও অপর পক্ষের দাবি, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালায় সেনাবাহিনী। সনাতনীদের ঘরে ঢুকে তাঁদের ওপরই অত্যাচার চালানো হয়। মহিলাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে গ্রেফতার করা হয় পুরুষদের। প্রমাণ লোপাটে সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। সমাজমাধ্যমে সেইসব ভিডিও আবার ভাইরাল করে দেন অত্যাচারিতরা। ধর্ম অবমাননার প্রতিবাদ করায় সনাতনীদের ঘরে ঢুকে মারধর করা হয় বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন নেটিজেনদের একাংশ।
এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার এবং সলিসিটর নিঝুম মজুমদার অভিযোগ করেছেন, ‘চট্টগ্রামের হাজারি গলিতে ঘরে-ঘরে ঢুকে সেনাবাহিনী হিন্দু ধর্মালম্বীদের হেনস্থা করছে, গ্রেফতার করছে। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সনাতনীরা জেগে উঠুন।’ নিঝুমের প্রশ্ন, ‘সেনাবাহিনী কি গণহত্যা শুরু করেছে?’
পুলিশ বা বাংলাদেশির সেনাবাহিনীর তরফে সেইসব বিষয় নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
তবে কী থেকে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত ? পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে, যে তাদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, চট্টগ্রাম পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, যে দিনকয়েক আগে ইসকন নিয়ে ফেসবুকে একটি হিন্দুবিরোধী বিতর্কিত পোস্ট করেন এই হাজারী গলিরই মিয়া শপিং সেন্টারের একটি দোকানের মালিক মহম্মদ ওসমান। একটি ফটোকার্ড শেয়ার করেন তিনি। তা নিয়ে হিন্দুধর্মের মানুষের মধ্যে তুমুল ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সেই ক্ষোভের বহ্নিই জ্বলে ওঠে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। মহম্মদ ওসমানের ওপর আক্রমণের চেষ্টা চালানো হয়। পাশাপাশি তাঁর দোকান ভাঙচুরও করা হয়। বিক্ষোভকারীরা ওই ব্যবসায়ীকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। বিক্ষুব্ধদের থামাতে ধাওয়া করে সেনাবাহিনী। গ্রেফতারও করা হয় বেশ কয়েকজনকে। এতেই তেঁতেঁ ওঠে পরিস্থিতি। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করতে গেলে তাদের ওপর পাল্টা চড়াও হন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে ‘অ্যাসিড’ ছুড়ে মারা হয়। এতে যৌথ বাহিনীর ১২ সদস্য আহত হন। যৌথ বাহিনীর টাস্কফোর্স-৪ চট্টগ্রাম এইসব তথ্য নিশ্চিত করে।
সংঘর্ষ চলে প্রায় ঘণ্টা তিনেক। রাত ১০ টা পর্যন্ত চলে রণক্ষেত্র পরিস্থিতি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে যৌথ বাহিনী। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের মধ্যে ৫০ জনকে আটক করা হয়। হাজারী গলি এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। খতিয়ে দেখা হচ্ছে পরিস্থিতি।
তবে মঙ্গলবার রাতের উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্ত হলেও সেই রাতের বেশ কিছু উত্তপ্ত ভিডিও ঘিরে ফের সমস্যা দানা বেঁধেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে আটক কয়েকজনের মোবাইল ফোনে কিছু নির্দেশনা সম্বলিত স্ক্রিনশট পেয়েছেন তারা। এগুলো থেকে তারা মন্দির ভাঙচুর চালিয়ে পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তোলার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে পেরেছেন। পরিকল্পিতভাবে মন্দির এবং মূর্তি ভাঙার তথ্য পাওয়ার পর হাজারী গলিসহ চট্টগ্রামের অন্যান্য এলাকার মন্দিরের নিরাপত্তা জোরদার করেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ।
চট্টগ্রামের ওয়াসার মোড়ের অদূরে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের কার্যালয়। মঙ্গলবার রাতে সেখান থেকে শোনা যায় আর্তনাদের শব্দ। চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে সোনা ও ওষুধের দোকানগুলিতে সিল গালা করে দেওয়া হয়।
সনাতনীদের উপর পুলিশ ও সেনার যৌথ হামলায় জামাত শিবির ও বিএনপির হাত রয়েছে বলে বিক্ষোভকারীদের একাংশের মত। অন্যদিকে সেনাবাহিনী জানায়, আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গিয়েছে, চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে মন্দিরে হামলা ও মূর্তি ভাঙচুরের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চলছে। পালিয়ে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এক নেতার নির্দেশেই পাঞ্জাবী ও টুপি পরিহিত অবস্থায় ছদ্মবেশে মন্দিরে হামলা চালানো হয়েছে।
যে পোস্ট নিয়ে বিতর্কের জল গড়াল এতদূর, সেই কথা ইসকন নিয়ে এখনও পর্যন্ত অন্য কোনও দেশই বলেনি। চিন, আমেরিকার মতো ধুরন্ধর দেশেও ইসকন রয়েছে। তবুও ইসকনের বিরুদ্ধে আঙুল তোলেনি কেউই। তবে কেন বাংলাদেশে ইসকন নিয়ে এত দলাদলি, প্রশ্ন জাগাচ্ছে জনমানসে।