পৌষালী উকিল, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বাংলাদেশকে এবার পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়ার হুমকি দিলেন আদানি পাওয়ার লিমিটেডের কর্নধার গৌতম আদানি। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা বিনা বাংলাদেশে বকেয়া বিদ্যুত্ বিল। বকেয়া ৮৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। পাওনাদার আদানি গোষ্ঠীর মালিক গৌতম আদানি। ডেডলাইন পেড়িয়েছে ৩১ অক্টোবরেই। তারপরও আল্টিমেটাম দেওয়া হল ৭ নভেম্বর। পাওনা টাকা এরমধ্যে পরিশোধ না করলে ৭ নভেম্বর থেকেই বাংলাদেশে বিদ্যুত্ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। বাংলাদেশ সরকারকে এমনই হুঁশিয়ারি দেওয়া হল আদানি গোষ্ঠীর তরফে। বিদ্যুত্ চুক্তির জেরে ঝটকা খেল বাংলাদেশ। কিন্তু প্রশ্ন একটাই এত বকেয়া কীভাবে হল। এর জন্য ফিরে যেতে হবে কয়েক বছর আগে।
হাসিনা-আদানি গুপ্ত চুক্তি
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে যান। মুজিবকন্যার সঙ্গে তখনই আলোচনা হয়েছিল বিদ্যুত্ সরবরাহ সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়ে। মোদী-হাসিনার কথোপকথনে উঠে আসে একটিই নাম, গৌতম আদানি।
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যুত্ চুক্তি সাক্ষরিত হয়। যেটি ছিল হাসিনা-আদানির গুপ্ত চুক্তি। নাম দেওয়া হয় গোড্ডা বিদ্যুত্ প্রকল্প। সে সময় চুক্তিপত্রের লেখা খানিকটা জনতার সামনে প্রকাশ করা হলেও বেশিরভাগটাই রেখে দেওয়া হয়েছিল গুপ্ত।
কী কী ছিল সেই গুপ্ত চুক্তিতে ?
২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন পর্ষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চুক্তিটি স্বাক্ষর করে আদানি গোষ্ঠী। স্থির হয়, ২৫ বছরে মোট ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনাবেচা করা হবে। আদানি গোষ্ঠীর ঝাড়খণ্ডের কেন্দ্রের উৎপাদিত ১০০ শতাংশ বিদ্যুৎই কিনবে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে সরাসরি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আদানি গোষ্ঠী।
গোড্ডা টু বাংলাদেশ
চুক্তি অনুযায়ী ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলায় ১৬০০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিদ্যুত্ রফতানির জন্যই এই বিদ্যুত্ কেন্দ্রটি গড়া হয়। ওই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আদানি গোষ্ঠী আবার ইন্দোনেশিয়া থেকে উন্নতমানের কয়লা আমদানি করে।
২০১৯ সালের মার্চ মাস এই কেন্দ্রটিকে বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকার (এসইজেড) আওতাভুক্ত বলে ঘোষণা করে মোদী সরকার। চুক্তি ২০১৭-য় হলেও গোড্ডা কেন্দ্রটিতে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল-জুন মাসে। বাংলাদেশের মোট চাহিদার ৭ থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আদানি গোষ্ঠীর এই কেন্দ্র।
২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে বাংলাদেশকে মোট ১১,৯৩৪ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ রফতানি করেছিল ভারত। যা ভারত থেকে বাংলাদেশে রফতানি করা মোট বিদ্যুতের প্রায় ৬৩ শতাংশ। ওই টাকার অঙ্কে হিসাব করলে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ রফতানি করে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের ব্যবসা করেছে ভারত। যা ভারত থেকে বাংলাদেশে মোট রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ।
হাসিনা বিনা অন্ধকারে বাংলাদেশ !
সম্প্রতি কোটাবিরোধী আন্দোলনের জেরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট। প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে ও দেশত্যাগ করে চলে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু বাংলাদেশকে ফেলে রেখে যান লোকসান ও অন্ধকারের মুখে। ৭ বছর আগের হাসিনা-আদানি গুপ্ত বিদ্যুত্ চুক্তির ফলে চরম বিপাকে পড়ে যায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।
ইউনুসকে গৌতমের চিঠি
হাসিনা দেশ ছাড়তেই উত্তপ্ত বাংলাদেশে লোডশেডিংয়ের শঙ্কা জাগায় আদানি গোষ্ঠী। সম্প্রতি গৌতম আদানির সংস্থা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসকে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে জানায়, অবিলম্বে বকেয়া মেটাতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে।
পিডিবিকে চিঠি আদানির
এর আগে আদানি গোষ্ঠী বাংলাদেশকে গড়ে ১ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুত্ সরবরাহ করত। তবে টাকা পরিশোধের সমস্যার কারণে গত ৩১ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে মাত্র ৫৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সরবরাহ করা আসছে আদানি পাওয়ার। শুধু তাই নয় আদানি পাওয়ার চিঠি দিয়ে বিদ্যুত্ উন্নয়ন পিডিবিকে জানায়, সময়মতো বকেয়া পরিশোধ না করায় তাঁদের বিদ্যুত্ সরবরাহ চুক্তির শর্ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। এটি পুরো সাপ্লাই চেনকেই ঝুঁকিতে ফেলছে।
ভূমিকা নেই ভারত সরকারের
বাংলাদেশের বিদ্যুত্ সরবরাহের বিষয়ে ভারত সরকারের কোনও ভূমিকা নেই বলে জানিয়েছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। তিনি বলেন, এটি একটি বেসরকারি সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যেকার চুক্তি। বিষয়টি দুই পক্ষের চুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত।
আদানির বকেয়ার জের
শুধু আদানি গোষ্ঠী নয়। বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রও বকেয়া সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশের বিদ্যুত্ উত্পাদনের ক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও গড়ে দৈনিক চাহিদা মাত্র ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। তবে এই বকেয়া পরিশোধের সঙ্কট এবং এলসি বা ঋণপত্রের সমস্যাগুলোর সমাধান যদি না হয়, তাহলে এই বিদ্যুত্ চাহিদাও মেটানো কঠিন হতে পারে। তাই আদানি পাওয়ারের এই আল্টিমেটাম বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে ইউনুস সরকারে দেশে।
প্রেস সচিবের আশ্বাস
বকেয়া পরিশোধে আদানির আল্টিমেটামের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের খবরে মর্মাহত সরকার। এ পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগ সরকার দায়ী। তবে পাওনা পরিশোধের সর্বক্ষমতা এই সরকারের আছে বলেই আশ্বাস দেন প্রেস সচিব।
গোপন চুক্তি সবার সামনে
২৫ বছরের জন্য করা হাসিনা-আদানি গোপন চুক্তি নিয়েই বড়সড় ঝটকা খেয়েছে বাংলাদেশ। গুপ্ত বিদ্যুত্ চুক্তিরই এখন মাসুল গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী ইউনুস সরকারকে। একসময়ের গুপ্ত চুক্তি রইল না আর গোপনে। সবটাই এখন সবার সামনে।
তবে কি এবার হাসিনা বিনা অন্ধকার হয়ে যাবে বাংলাদেশ ? নাকি আলোর পথ দেখাবে ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।