নাজিয়া রহমান, সাংবাদিক শূন্য বাঞ্ছারামের বাগান। প্রয়াত নাট্যকার, অভিনেতা মনোজ মিত্র। বাংলা নাট্যজগত যাকে যুগ যুগ ধরে মনে রাখবে। মঞ্চে হোক কিংবা ক্যামেরার সামনে। অ্যাকশন মানেই মনোজ মিত্র একপলকে অন্য চরিত্র। পজেটিভ-নেগেটিভ দুই চরিত্রই সমান দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতেন এই দক্ষ অভিনেতা। এক সময় টলিপাড়ার স্বর্ণযুগে রাজত্ব করেছেন মনোজ মিত্র। কেবল অভিনয় নয়, তাঁর লেখা নাটকেও কৌতুকের যে রসদ থাকত, তা দর্শকেরা তাড়িয়ে-তাড়িয়ে উপভোগ করতেন। তাঁকে ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবক বলা হয় , কারণ তাঁর হাত ধরে তৈরি হয়েছেন বহু শিল্পী। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার সাতক্ষীরাতে জন্ম মনোজ মিত্রের। স্বাধীনতার শেষ লগ্নেও তিনি জানতে তার দেশ খুলনা ভারতেই পড়বে। কিন্তু হঠাৎই চোখের পলকে তাঁর জন্মস্থান বিভুঁই হয়ে যায়। রাষ্ট্রীক খামখেয়ালকে কি এক মশকরা হিসেবে দেখেছিল তখনকার বালক মনোজ মিত্র। তাই কি তার রচিত নাটকে, তাঁর অভিনয়ে একটা কৌতুক মিশ্রিত প্রতিবাদ ধরা পড়েছে? যদিও সে প্রশ্নের উত্তর অজানা।
১৯৫০ সাল নাগাদ মনোজ মিত্র চলে আসেন এ পার বাংলায়। স্কুলজীবন থেকে তাঁর থিয়েটারচর্চার সূত্রপাত। ১৯৫৪ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলে সহপাঠী হিসাবে পান বেশ কিছু তাঁর মত মানসিকতার মানুষকে। তারই মধ্যে কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সৃজনশীল বিষয়ে উৎসাহদাতা। এই সময়েই মনোজ ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। পরে এই কলেজেই দর্শনে অনার্স নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা চলাকালীন পার্থপ্রতিম চৌধুরীর মতো বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নাটকের দল ‘সুন্দরম’। এই পর্ব থেকেই পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন নাটকের সঙ্গে। ১৯৫৭ সালে কলকাতার নাট্যমঞ্চে প্রথম অভিনয় করেন মনোজ মিত্র। ১৯৫৯ সালে মনোজ মিত্র যখন তাঁর প্রথম নাটকটি লেখেন তখন বাংলা নাট্য জগতে দুই প্রবল নাট্যব্যক্তিত্বে টানাপোড়েন চলছে। তাদের মধ্যে একজন শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্ত। বিভাজনের নিরিখে একজন কাজে অনুভূতির প্রাধান্য লক্ষিত আর একজনের বক্তব্যের প্রাধন্য। এই দুই ধারাকে মেলালেন মনোজ মিত্র তাঁর লেখনিতে। সমাজ ও রাজনীতির নিপুন পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করা যায় তাঁর রচিত নাটকে। বিশেষ সামাজিক অবস্থায় মানুষ সমস্যা থেকে কিভাবে নিষ্কৃতি পাবে তাঁর ইঙ্গিত মেলে মনোজ মিত্রের রচিত নাটকগুলিতে। মনোজ মিত্রের লেখা প্রথম নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’। তারপর ১৯৭২ সালে ‘চাকভাঙা মধু’ নাটক দিয়ে পর্দার সামনে আসেন তিনি। এ ছাড়া মঞ্চনাটক, যাত্রা, আকাশবাণীর নাটকে অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। মনোজ মিত্রের লেখা উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো— ‘চাকভাঙা মধু’, ‘নৈশভোজ’, ‘চোখে আঙ্গুল দাদা’,‘দর্পণে শরৎশশী’, ‘কাল বিহঙ্গ’, ‘অশ্বত্থথামা’, ‘নরক গুলজার’, ‘সাজানো বাগান’, ‘মেশ ও রাখাল’, ‘অলকানন্দর পুত্রকন্যা’ উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৭ সালে মনোজ লিখলেন ‘সাজানো বাগান’। প্রধান ভূমিকায় তিনি নিজেই ছিলেন। বাংলা নাটকের দর্শক উপহার পেলেন এমন এক নাটক, যার ‘ধরন’-এর সঙ্গে তেমন পরিচয় তাঁদের ছিল না বললেই চলে। ১৯৭৯ সালে সিনেমা জগতে প্রথম পা রাখেন তিনি। প্রায় ৬০টির মত সিনেমাতে অভিনয় করেন মনোজ মিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘৬১ নম্বর গড়পার লেন’,‘আগুন’, ‘চক্র’, ‘দত্তক’, ‘হিংসা’, ‘আবির্ভাব’ ও ‘তুফান’। ‘উমা’, ‘প্রেম বাইচান্স’, ‘অমর সাথি’, ‘ভালোবাসি শুধু তোমাকে’। অভিনয়ের জন্য সংগীত নাটক একাডেমি পদকসহ একাধিক পুরস্কার পান তিনি। কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষও ছিলেন এই অভিনেতা। এই মহান শিল্পীর প্রয়ান বাংলা নাট্যজগৎ ও সিনেমা জগতে বিরাট ক্ষতি……………………