নাজিয়া রহমান, সাংবাদিক: এবার আন্দোলনে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা। নদীপথে শুরু হয়েছে তাদের আন্দোলনের যাত্রা। এই যাত্রার নাম মৎস্যজীবী অধিকার যাত্রার নভেম্বর মাসের সপ্তাহে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে।ফ্রেজারগঞ্জ থেকে ফারাক্কা মৎস্যজীবী অধিকার যাত্রার সপ্তম দিনে দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলার গঙ্গাসাগর, পাতিবুনিয়া, রাজনগর, ট্যাঁকার বাজার দুর্গাপুর, নামখানা, লট এইট, কাকদ্বীপ ফিশিং হারবার, ১লা নম্বর কুলপি, ট্যাংরা চর, হাঁড়া, থানাব্যেড়া, কাঁটাখালি, কেন্দ্যামারি, কুমারচক, রূপনারায়াণ চক, বেগুনাবেরা, এঁড়িয়াখালি, গেঁওখালি, গাদিয়ারা, তারাগঞ্জ, পুকুরিয়া, গোদাখালি ঘুরে মৎস্যজীবী অধিকার যাত্রা ২ ডিসেম্বর ২০২৪ বাবুঘাটে এসে পৌঁছেছে এই মিছিল।
মৎস্যজীবীদের বক্তব্য, তাঁরা দেশের সমুদ্র খাল বিল নদী নালা পুকুরে মাছ ধরে বা মাছ চাষ করে পেট চালাই। তবে তাঁরা শুধু নিজেদের পেট চালাই না, দেশের আশি কোটিরও বেশি মানুষের পাতে সস্তায় সবথেকে ভালো প্রাণীজ প্রোটিন মাছ তুলে দেয়। তাঁদের কাজ দেশের মানুষের খাদ্য সুরক্ষা ও পুষ্টির যোগান দেওয়া। অথচ প্রাকৃতিক জল, জলাশয় ও মাছের উপর তাঁদের কোন আইনি অধিকার নেই। প্রতিনিয়তই সমুদ্র উপকূল, নদী, জলাধার, জলাভূমি থেকে তাঁদের নির্বিচারে উৎখাত করা হচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ,উন্নয়নের নামে একের পর এক বন্দর, বৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র, জল পরিবহণ পথ ইত্যাদি করে উপকূল, নদী বা অন্যান্য জলাশয়গুলিকে দখল করা হচ্ছে শুধু তাই নয়, উপকূল নদী বা জলাশয় সংলগ্ন জমিও দখল হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে মাছ ধরার জায়গা ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে। বার্জ আর জাহাজের ফলে নদীতে বা উপকূলে পাতা জাল ছিঁড়ে দিচ্ছে। মাছ ধরা নৌকাগুলির ক্ষতি করছে। জাহাজের প্রোপেলারের ঘূর্ণন থেকে উদ্ভূত ঢেউ ও বিকট ইঞ্জিনের শব্দে মাছের বাস্তুতন্ত্র ভেঙ্গে পড়ছে। নদীগুলির উপর যত্রতত্র ব্যারেজ নির্মাণ করে মাছের স্বাভাবিক চলাচল, বৃদ্ধি, প্রজননে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। মাছ ধরার জন্য মৎস্যজীবীরা বংশ পরম্পরায় যে ভূমি ব্যবহার করতেন তা তাঁদের হাত ছাড়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় অনিয়ন্ত্রিত নির্মানের কারণে নদী আর জলাভূমির জল সংগ্রহ এলাকাগুলিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে মৎস্যজীবীদের বক্তব্য । নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জল নিকাশি ব্যবস্থা। মৎস্যজীবীদের আরও অভিযোগ নদীগুলো থেকে জল তুলে নেওয়া হচ্ছে সেচ, কল-কারখানা আর নাগরিক ব্যবহারের জন্য। নদী-সমুদ্রে মিশছে জাহাজের তেল, রঙ। নদীতে যাচ্ছে কলকারখানা, পৌর এলাকা বা চাষের ক্ষেত ধোয়া দূষিত, নোংরা, রাসায়নিক মিশ্রিত জল। এর উপর স্বার্থান্বেষী লোকেরা ট্রলিং, মশারি জাল, বিষ, বিস্ফোটক, ইলেকট্রিক শক, বাঁধাল ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক পদ্ধতিতে মৎস্য শিকার করার ফলে সমুদ্র, নদী, জলাশয়ে মৎস্য সম্পদ ব্যাপক আকারে কমে যাচ্ছে। যার ফলে সমস্যায় পড়ছেন ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা। মাছ ছাড়া মৎস্যজীবী বাঁচতে পারে না, আর ভালো জল ছাড়া ভালো মাছ হয় না বলে তাঁদের বক্তব্য।
জলের উপর যাদের সর্বক্ষণ বিচরণ অথচ জলের জন্য কোন আইনি অধিকার নেই তাঁদের বলে জানাচ্ছেন মৎস্যজীবীরা। মৎস্যজীবীদের আরও অভিযোগ – নদী, জলাধার, খাল বিল জলাশয়ে উচ্চ মূল্যে লিজ দিয়ে, কোথাওবা খাঁচায় মাছ চাষের পরিকল্পনা করে জেলেদের স্বাধীনভাবে বংশ পরম্পরায় মাছ শিকারের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জলাশয়গুলিতে লিখিত লিজ না হওয়ায়, ইচ্ছেমতো লিজের ভাড়া বাড়ানোয় এবং লিজ বাতিল করায় লিজভিত্তিক মৎস্যচাষিরা লিজের নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন। এইসকল কারণে জলের উপর মৎস্যজীবীদের অধিকার তথা সমষ্টিগত পাট্টার দাবিতে এবং সকল প্রকার ধ্বংসাত্মক মৎস্য শিকারের বিরুদ্ধে দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম ফ্রেজারগঞ্জ থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত গঙ্গাপথে নৌ-প্রচার অভিযান করছে। এই প্রচার অভিযানের আরাম্ভ হয়েছে ২৬ শে নভেম্বর ২০২৪ সকাল ৮ টায়, ফ্রেজারগঞ্জে। এই দীর্ঘ প্রচার অভিযানে সকল মৎস্যজীবী, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিক সকলেই অংশগ্রহণ করছেন। মৎস্যজীবীদের দাবি, জলাশয়ে দূষণ, দখলদারি, অতিরিক্ত জল আহরণ বন্ধ করতে হবে।
নদীগুলি সংস্কার করো। সব মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও সমষ্টিগত মৎস্যকর্মের জায়গাগুলিতে সমষ্টি পাট্টা প্রদান করতে হবে। ট্রলিং, মশারি জাল, বিষ, বিস্ফোটক, ইলেকট্রিক শক, বাঁধাল ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক মৎস্য শিকার বন্ধ করতে হবে।মশারিজাল ব্যবহারকারী মৎস্যজীবীদের চিহ্নিত করে ভর্তুকি মূল্যে ফাঁসজাল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।বিপজ্জনক টিনের ডোঙার বদলে ভর্তুকি মূল্যে ফাইবারের ডোঙা দিতে হবে।সরকারী জলাশয় নিলাম বন্ধ করে এবং ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের ব্যবহার করতে দিতে হবে।ব্যক্তিগত জলাশয়ে ক্ষুদ্র মৎস্য চাষীদের লিজের নিরাপত্তার জন্য আইনি সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। মাছ বাজারগুলির সংস্কার সহ উন্নত মৎস্য বিপনন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।সমুদ্রসাথী প্রকল্পের মতো নদী ভিত্তিক আভ্যন্তরীণ মৎস্যজীবীদের মাছ ধরা বন্ধ বা কম হওয়ার সময় মাসে ৫০০০ টাকা জীবিকা সহায়তা করতে হবে। অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক ক্ষেত্রের সকল ছোটো মাছ ধরা নৌকাগুলিকে (দাঁড়পাল থেকে ৩০ হর্সপাওয়ার পর্যন্ত) অবিলম্বে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এই দাবিগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।