৯ ই আগস্ট আরজি করে তিলোত্তমার ধর্ষণ এবং খুনকে কেন্দ্র করে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল তা বছর শেষেও অব্যাহত। তিলোত্তমার ন্যায়বিচার চেয়ে যে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল শহর তিলোত্তমা, তার ভিত্তিতে বলাই যায় ২০২৪ সাক্ষী থাকল এক অন্য জনজাগরণের।
সায়ন্তিকা ব্যানার্জি, সাংবাদিক: রাজ্য তথা দেশে খুন ধর্ষণ নতুন কোন ঘটনা নয় কিন্তু আর জি কর একেবারেই ব্যতিক্রম। অন ডিউটি অবস্থায় একজন চিকিৎসককে তার হাসপাতালেই ধর্ষণ করে খুন করে চলে যাওয়ার মতন ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে। সেই ঘটনার প্রতিবাদে যে আন্দোলনের ঝড় উঠেছিল রাজ্য দেশ এমনকি বিদেশের বুকেও, তার জেরে ২০২৪ সাল সাক্ষী থাকলো এক টালমাটাল পরিস্থিতির।
৯ ই আগস্ট আর জি করের সেমিনার হল থেকে উদ্ধার হয় তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষিতা মৃতদেহ। তারপরের দিন থেকেই লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। তাদের অভিযোগের আঙুল ছিল আরজিকরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের দিকে। দীর্ঘদিন ধরেই হাসপাতালে জুড়ে যে থ্রেট সিন্ডিকেট চালাতেন বলে অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে তা চলে আসে একেবারে প্রকাশ্যে। এরমধ্যেই ১৪ ই আগস্ট একটা অভূতপূর্ব রাতের সাক্ষী থাকলো গোটা সমাজ। রাত দখল করতে মেয়েরা নামলেন পথে, অবশ্য শুধু মেয়েরা নয় সেই মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন ছেলেরাও। সেদিন বয়সের কোন বেড়াজাল ছিল না মোমবাতি হাতে সকলের মুখে ছিল একটাই স্লোগান জাস্টিস ফর আরজি কর। আর ঠিক সেই সময়েই ফের আরজি করে ঘটে গেল আরো এক ন্যক্কারজনক ঘটনা। বহিরাগতদের তাণ্ডব চলল আরজিকরের এমার্জেন্সি বিভাগে। সমস্ত কিছু ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হল। সেমিনার হলের ওপরেও আক্রমণ করার চেষ্টা হল তবে তা আটকে গেল ফ্লোরের হিসাবে ভুল করার জন্য। এর মধ্যেই সন্দীপ ঘোষকে সাসপেন্ড করা হলো। সিবিআই লাগাতার জেরা শুরু করলো তাকে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সময় ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ ছিল জাস্টিস ফর আরজি কর। প্রত্যেকদিন একাধিক মিছিল হচ্ছে শহর কলকাতা সহ বিভিন্ন জায়গায়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে একাধিক সেলিব্রেটি মানুষ তারাও সামিল হচ্ছেন আন্দোলনে। দেশজুড়ে জুনিয়র রেসিডেন্টরা কর্ম বিরতিতে, এক অদ্ভুত টালমাটাল পরিস্থিতি। এই আবহেই অবশেষে গ্রেফতার হলেন সিবিআইয়ের হাতে সন্দীপ ঘোষ, আর্থিক দুর্নীতি এবং খুন ও ধর্ষণের মামলায়। তবুও ক্ষোভের আগুন এতোটুকু স্তিমিত হলো না। জুনিয়র চিকিৎসকরা চললেন স্বাস্থ্য ভবন অভিযানে বাধা পেয়ে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করলেন তারা। আর তাদের সমর্থন করতে তাদের পাশে থাকতে সাধারণ মানুষ মিলে এক অদ্ভুত পদক্ষেপ নিলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবার থেকে শুরু করে জল ব্লিচিং পাউডার ফিনাইল এমনকি জামা কাপড়ও পাঠাতে শুরু করলেন তারা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটে গেলেন সেই অবস্থান মঞ্চে। নবান্নে মিটিং হবে কি হবে না সেই নিয়ে চলল দড়ি টানাটানি। বেশ কয়েকবার মিটিং ব্যর্থ হলেও তারপর মুখ্যমন্ত্রী এবং জুনিয়র চিকিৎসকরা বৈঠকে বসলেন, সরিয়ে দেওয়া হল তৎকালীন সিপি বিনীত গোয়েলকে এবং আরো কিছু রদবদল হলো।
নিজেদের সমস্ত দাবি দেওয়া পূরণ করতে তার কিছুদিনের মধ্যেই ধর্মতলায় অনশন শুরু করলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। পুজোর মধ্যেও চলল সেই অনশন। এরপর যেদিন রেড রোডে পুজো কার্নিভাল চলছে রানী রাসমণি রোডে দ্রোহের কার্নিভালে উপচে পড়লো মানুষের ভিড়। তার কিছুদিনের মধ্যেই মুখ্য সচিব গেলেন অনশন মঞ্চে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হল আন্দোলনকারীদের। ফের নবান্নে বৈঠক। অবশেষে অনশন উঠলো।
ডিসেম্বরে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হলেও আন্দোলন এখনো জারি রয়েছে। সিনিয়র জুনিয়র চিকিৎসকরা সাধারণ মানুষ একথা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন বিচারে না আসা অব্দি লড়াই জারি থাকবে। অগাস্ট থেকে ডিসেম্বর এই যে আন্দোলনের সাক্ষী থাকলো শহর কলকাতা এমন আন্দোলন বহুদিন হয়নি। এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ মানুষ কবে কোন মিছিলে পা মিলিয়েছেন তা খুব একটা মনে করে বলা যায় না। ২০২৫ সাল আসছে, নির্যাতিতা অবশ্যই বিচার পান কিন্তু নতুন বছরে আর একটাও তিলোত্তমার ঘটনা না ঘটে।