মাম্পী রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ জীবনে কোনওকিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। এই যুগে কোনওকিছু বিনামূল্যে পেলে একটু সাবধান হয়ে যান, কোনও না কোনওভাবে এই মূল্য চোকাতে হবে আপনাকে। কিন্তু এই যুগেও সত্যিই একেবারে বিনামূল্যে যদি কিছু পাওয়া যায় এবং সীমাহীনভাবে তা পাওয়া যায়। তা হল পর্ন বা নীল ছবি। ফোন বা কি বোর্ডের বোতাম চাপলেই চোখের সামনে হাজির হয়ে যায় এই অ্যাডাল্ট সিনেমা। যা দেখার জন্য নির্ধারিত বয়স ১৮ বছরের উর্ধ্বে। যদিও সেই নির্দেশিকা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েই কিশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক এমনকি অশীতিপররাও দিব্যি মজা নিচ্ছেন নীল ছবির।
এই যুগে তো কোনওকিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না, তবে অসংখ্য অ্যাডাল্ট কনটেন্ট বা নীল ছবি কীভাবে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে ? এই প্রশ্ন তো আপনার মনেও কোনও না কোনওসময় উঠেছে। বিনামূল্যে কনটেন্ট দেখিয়ে কীভাবে আয় করে এইসব পর্ন ইন্ডাস্ট্রি ?
১৯৫৩ সাল। আমেরিকারের বাসিন্দা তথা পাবলিশার হিউ হেফনরের ৮ হাজার ডলারের প্রয়োজন ছিল। সেজন্য একটি ম্যাগাজিন তৈরি করেন তিনি। যার কভার পেজে ছিল বিখ্যাত হলিউড হিরোইন মার্লিন মোনরোর ছবি। ১৯৫০ সালে সবচেয়ে বড় পপ আইকন হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ম্যাগাজিনের কভার পেজে লেখা ছিল প্লে বয়, এন্টারটেইনমেন্ট ফর মেন। মার্লিন মোনরো কেরিয়ারের শুরুতেই কিছু নিউড ফটোশ্যুট করেছিলেন। যা তুলে ধরা হয়েছিল ওই ম্যাগাজিনে। যে ম্যাগাজিনের ৫০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। প্লে বয় ম্যাগাজিন এটা প্রমাণ করে দেয় যে এইধরণের অ্যাডাল্ট কনটেন্টের চাহিদা ব্যাপক। ধীরে ধীরে যুগ পাল্টাতে থাকে। ১৯৮০ সালে, অ্যাডাল্ট কনটেন্ট আস্তে আস্তে ভিডিওতে পা রাখতে শুরু করে। কালো রঙের ভিডিও ক্যাসেটের মাধ্যমেই ঘরে ঘরে ঢুকতে শুরু করে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট। তারপর ১৯৯০ সালে প্রযুক্তি আরও দুই পা এগিয়ে যায়। ইন্টারনেটের আগমন তারপর www আসায় অ্যাডাল্ট কনটেন্ট ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইন্টারনেট আসার আগে এই অ্যাডাল্ট ইন্ডাস্ট্রি বাকি মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির মতোই কাজ করত। প্রিন্ট ম্যাগাজিনের পাশাপাশি, ডিভিডি এবং ভিডিও ক্যাসেট বিক্রি এবং তার হোটেল কিংবা কেবল চ্যানেলে ভিউয়ার্স কত, তার সংখ্যার উপর নির্ভর করত পর্ন ইন্ডাস্ট্রির আয়। মানুষজন লুকিয়ে লুকিয়ে এধরণের অ্যাডাল্ট সিরিজ দেখতেন। কিন্তু ইন্টারনেটের আগমনের পর বদলে যায় পুরো ছবিটা। যেখানে যখন খুশি ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্ন দেখতে পারেন মানুষজন। ২০০০ সালের শুরুতে অ্যাডাল্ট কনটেন্টের সাবস্ক্রিপশন কেনের ব্যবস্থা ছিল। টাকা নিয়ে সাবস্ক্রিপশন কিনলে সেখানে থাকা ভিডিও অ্যাকসেস করা যেত সহজেই। তার পাশাপাশি কিছু ভিডিও থাকতো টিসার বা ট্রেলারের মতো। যা দেখলে সেখানে থাকা ভিডিওর ধারণা পাওয়া যাবে। পুরো ভিডিও দেখার জন্য সাবস্ক্রিপশন করতে হবে, উল্লেখ করা থাকতো ওয়েবসাইটে। এইভাবেই ফ্রি কনটেন্ট দেখানো হত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে।
একটি ডেটা অ্যানালিসিস সংস্থা স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ইন্টারনেটে যত ওয়েবসাইট আছে, তাদের মধ্যে ৪ শতাংশ ওয়েবসাইটে রয়েছে শুধুমাত্র অ্যাডাল্ট কনটেন্ট। ইন্টারনেটের মাধ্যমে করা ওয়েব সার্চের মধ্যে ১৩শতাংশ অ্যাডাল্ট কনটেন্টের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। মোবাইল সার্চ হিস্ট্রির ডেটা বলছে, ২০ শতাংশ ইন্টারনেট সার্চ পর্ন বা অ্যাডাল্ট কনটেন্ট। এই নিয়ে প্রকাশ্যে আসা একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, নীল ছবির ইন্ডাস্ট্রির বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকার সমান। অ্যাডাল্ট ছবির ইন্ডাস্ট্রির ক্যাপিটাল হিসেবে পরিচিত ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ফার্নান্ডো ভ্যালিতে প্রতিবছর প্রায় ১১হাজার নীল ছবির শ্যুট করা হয়। পাইরেসি এবং বিনামূল্যে নীল ছবি পাওয়া যায়। এর ফলে ব্যবসায় খানিকটা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও টলানো যায়নি নীল ছবির ব্যবসার ভিতকে।
বিনামূল্যে এত কনটেন্ট বিলির পরও প্রফিট কোথা থেকে করে এরা ?এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আরও একটি প্রশ্ন উঠে আসে, তা হল- টিউব সাইট কী ?
২০০৫ সালে ইউটিউবের পথচলা শুরু হয়। তারইসঙ্গে চালু হয় টিউব সাইট। যেখানে যেকোনও ইউজার নিজেদের ভিডিও আপলোড করতে পারেন। প্রতিদিন অ্যাডাল্ট কনটেন্ট আপলোডের মাত্রা বাড়তে থাকে। প্রথমে যেসব কনটেন্ট সাবস্ক্রিপশন করলেই পাওয়া যেত, সেগুলির কপি এবার টিউবসাইটগুলিতেও আপলোড হতে থাকে। পাইরেসির ফলে পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রিকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১৭,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় এই ইন্ডাস্ট্রির। পাইরেসির জন্য অ্যাডাল্ট কনটেন্ট বানানোর প্রোডাকশন হাউজগুলিকেও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের ব্যবসায় নয়া পদ্ধতি উঠে এসেছে। তা হল বিজ্ঞাপন বা প্রচারের মাধ্যমে আয়। এরপরই জন্ম হয় মাইন্ডগিক নামক সংস্থার। যা অ্যাডাল্ট কনটেন্টের ইউটিউব নামেও পরিচিত। এই সংস্থা বুঝে গিয়েছিল যে শুধুমাত্র সাবস্ক্রিপশনে কাজ হবে না। বিজ্ঞাপনও বাড়াতে হবে। যা দর্শকদের আড়াআড়িভাবে ২ভাগে ভাগ করে দেয়। এক, যারা বিনামূল্যে টিউবসাইটে এই কনটেন্টগুলিকে দেখেন। দ্বিতীয়, যারা সাবস্ক্রিপশন করে বিভিন্ন কনটেন্ট দেখেন। প্রথম ভাগের গ্রাহকদের জন্য একাধিক টিউব সাইট কিনতে থাকে মাইন্ড গিক। এর ফলে বর্তমানে ইন্টারনেট সার্চ করলেই প্রচুর অ্যাডান্ট কনটেন্টের সম্ভার বেরিয়ে আসে। বর্তমানে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রির ১০ টিউব সাইটের মধ্যে ৪টি রয়েছে মাইন্ডগিকের আওতায়। পর্ন হাব, রেডটিউবের মতো বড় বড় টিউবসাইট এই মাইন্ডগিকের মধ্যেই পড়ে। একাধিক প্রোডাকশন হাউজকেও কিনে নিয়েছে এই মাইন্ডগিক। ওই প্রোডাকশন হাউজে শ্যুট করা প্রিমিয়াম ভিডিও সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে বেচতে থাকে এই মাইন্ডগিক। অর্থাৎ দর্শক বিনামূল্যেও দেখতে পারেন আবার সাবস্ক্রিপশন করেও দেখতে পারেন পর্ন ভিডিও। সেই সমস্ত সাইটগুলি যার আওতায় পড়ে তা হল মাইন্ডগিক। দর্শকদের জন্য সমস্ত ধরণের বিকল্প রয়েছে সেই ওয়েবসাইটগুলিতে। একদিন, এক সপ্তাহ, একবছরেরও সাবস্ক্রিপশন পাওয়া যায়। কিছু ওয়েবসাইট আবার লাইফটাইম সাবস্ক্রিপশনও দেয়। যা ২৫ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কিছু গ্রাহক খুব কম সময়ের জন্য সাবস্ক্রিপশন করেন। সেক্ষেত্রে তাঁদের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের তথ্য দিতে হয় গ্রাহকদের। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সাবস্ক্রিপশন বন্ধ না করলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অটোমেটিকালি টাকা ডেবিট হয়ে যাবে এবং সাবস্ক্রিপশন রিনিউ হতে থাকবে। সাবস্ক্রিপশন ক্যানসেল করার অপশন খুঁজে পেতেও বেগ পেতে হয় গ্রাহকদের। কারণ যে ওয়েবসাইটে গ্রাহকরা পর্নোগ্রাফি দেখেন, সেখানে বিলিং হয় না। বিলিংয়ের জন্য আলাদা ওয়েবসাইট খুলে যায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বিনামূল্যেই নীল ছবি দেখেন। এর মধ্যেও একাধিক উইন্ডো খুলে দিয়ে প্রলোভন দেওয়া হয় গ্রাহকদের। ওই সব উইন্ডোতে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। যেখানে প্রিমিয়াম অ্যাডাল্ট কনটেন্ট থাকে, কিংবা যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। অনেকসময় আবার অনলাইন সেক্স কিংবা এসকর্ট সার্ভিসের বিজ্ঞাপনও চলে আসে ওইসব উইন্ডোগুলিতে। এর ফলেই মোটা টাকা আয় করে অ্যাডাল্ট ছবির ইন্ডাস্ট্রি। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে বিশ্বজুড়ে পপুলার ওয়েবসাইটগুলির মধ্যে মাইন্ডগিকের পর্নহাব রয়েছে ১২ নম্বরে। অ্যামাজনের মতো বড়সড় শপিং অ্যাপকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে এই মাইন্ডগিক। এই ওয়েবসাইট একা বছরে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করে। যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।
অ্যাডাল্ট কনটেন্টে কর্মরত হিরো-হিরোইনের আয় কত ?
বিশেষত অ্যাডাল্ট কনটেন্টে কর্মরত হিরো হিরোইনদের আয় নির্ভর করে তাঁদের বয়স এবং পপুলারিটির উপর। এছাড়া ছবির উপর নয় বরং দৃশ্যের উপর তাঁদের আয়ের পরিমাণ নির্ভর করে। চর্চিত পর্ন তারকা ভ্যালেন্টিনা ন্যাপি একটি সাক্ষাৎকারে জানান, আমেরিকার অ্যাডাল্ট কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই পপুলার হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রথম থেকেই অন্যান্যদের থেকে বেশি আয় করতেন তিনি। রেগুলার হেট্রোসিন করতে হত বলে জানিয়েছেন ভ্যালেন্টিনা। যে দৃশ্যে পুরুষ, মহিলা দুইই সামিল থাকেন। এই দৃশ্যের জন্য ৯১৫ পাউন্ড অর্থাৎ ১ লক্ষ টাকা হাতে পেতেন তিনি। ২২-২৬ বছরের তারকারা সবচেয়ে বেশি আয় করেন এই পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে। তাঁদের কাজ পাইয়ে দেন এজেন্টরা। সেই এজেন্টরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ টাকা নিয়ে নেন। একটি রিপোর্টে উঠে এসেছে, অ্যাডাল্ট কনটেন্ট ইন্ডাস্ট্রির এজেন্টের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নাম মার্ক স্পিগলার। তিনি বলেন এই ইন্ডাস্ট্রির টপ মহিলা তারকার আয় প্রতিবছরে প্রায় ৩লক্ষ ৫০হাজার ডলার বা ৩ কোটি টাকা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পুরুষ তারকাদের আয় প্রায় ১ লক্ষ ডলার অর্থাৎ ৮৫ লক্ষ টাকা। স্পিগলার আরও জানিয়েছেন, যেসব মহিলা পর্ন তারকাদের ডিমান্ড বেশি থাকে, তাঁদের আয় সিন প্রতি ৮০০ ডলার থেকে ৪হাজার ডলার হতে পারে। ভারতীয় মুদ্রায় যা ৭০হাজার থেকে সাড়ে ৩লক্ষ টাকা। পুরুষ তারকাদের আয় অনেক কম। ৪৩০ পাউন্ড বা ৫০হাজার টাকা প্রতি সিনে দেওয়া হয় পুরুষ পর্ন তারকাদের। সুতরাং বিনামূল্যে অসংখ্য কনটেন্ট প্রকাশ করেও পর্ন সাইটগুলি এত আয় করে কী করে, তা পুরোটাই স্পষ্ট হয়ে গেল এই প্রতিবেদনে। এধরণের আরও প্রতিবেদন পেতে চোখ রাখুন আরপ্লাস নিউজের ডিজিটাল পেজে।