মাম্পি রায়, নিজস্ব প্রতিনিধি: বছর চারেক আগে গোটা দেশ তথা বিশ্বে কার্যত ত্রাশের রূপ নিয়েছিল করোনা ভাইরাস। কয়েকদিন আগে মাথাচারা দিয়েছিল এইচএমপিভি। এবার আতঙ্ক ছড়াচ্ছে গিলেন বেরি সিনড্রোম। মহারাষ্ট্রে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে এই স্নায়ুরোগ। ইতিমধ্যে গিলেন বেরি সিনড্রোমের জেরে মৃত্যু হয়েছে পুনের এক চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের। গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। তাঁর শরীরে ডায়েরিয়ার উপসর্গ ছিল। স্বাস্থ্যপরীক্ষার পর গিলেন বেরি সিন্ড্রোম ধরা পড়ে তাঁর। কয়েকদিন আইসিইউতে থাকার পর, বাইরে বের করা হলে শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। তারপরই প্রাণ হারান তিনি। পুনেতে শতাধিক মানুষ গিলেন বেরি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ১৪ জন আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন। সকলেরই ডায়রিয়া, ঘনঘন বমি, জ্বর, গায়ে ব্যথার মতো উপসর্গ রয়েছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তরফে একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠানো হয়েছে পুনেতে। ৭ সদস্যের ওই দলের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সার্ভে করছেন। কীভাবে ওই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। আর কেউ আক্রান্ত হয়েছেন কিনা, তাঁদের শরীরে কেমন উপসর্গ রয়েছে, সেসবও খতিয়ে দেখছেন ওই বিশেষজ্ঞদলের সদস্যরা।
অন্যদিকে, গিলেন বেরি সিনড্রোমের জেরে কলকাতার NRS মেডিক্যালে মৃত্যু হল আরেক কিশোরের। মৃত উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙার বাসিন্দা অরিত্র মণ্ডল বারাসাত গর্ভনমেন্ট স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। ২১ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। ২৮ জানুয়ারি মৃত্যু হয় তার। ডেথ সার্টিফিকেটে সেপটিক শক, GB সিনড্রোমের উল্লেখ রয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ওই কিশোরকে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তার হাত এবং শরীরের বেশ কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে যাচ্ছিল। সেখান থেকে ২৩ জানুয়ারি তাকে NRS-এ স্থানান্তরিত করা হয়। এনআরএস তাকে প্রথমে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে। জোর করলে ভর্তি নেওয়া হয়। কিন্তু দু’দিন পর থেকেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তার শরীরে জিবি সিনড্রোম শনাক্ত করা গেলেও, যে বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল তা দেওয়া হয়নি। পরে প্লাজমা থেরাপি করেও শেষরক্ষা হয়নি। মৃত্যু হয়েছে ওই কিশোরের। ডেথ সার্টিফিকেটে জিবি সিনড্রোমের উল্লেখ করা হয়েছে।
বঙ্গে আরও এক জিবি সিন্ড্রোমে আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে। জগদ্দলের বাসিন্দা ওই শিশুটি গত এক সপ্তাহ ধরে বি সি রায় শিশু হাসপাতালের ভর্তি ছিল। ২৬জানুয়ারি মৃত্যু হয় তার।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, গিলেন বেরি সিনড্রোম নামক এই জটিল স্নায়ুরোগের জেরে ব্যহত হয় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সরাসরি স্নায়ুকে আক্রমণ করে এই ভাইরাস৷ সাধারণ ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাসঘটিত সংক্রমণে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে ৷ এই রোগে আক্রান্ত হলে, স্নায়ুগুলিও ঠিকমতো কাজ করে না৷ হাত, পা অসাড় হয়ে যায়৷ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে৷ এছাড়াও শ্বাসকষ্টের সমস্যা, খাবার খেতে সমস্যাও দেখা দেয় গিলেন বেরি সংক্রমণে৷ এই পরিস্থিতিতে মানুষজনকে বাইরের খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। পাশাপাশি জল ভালো করে ফুটিয়ে খেতে বলেছেন তাঁরা।
যদিও গিলেন বেরি সিনড্রোম নতুন কোনও ধরনের বা বিরল কোনও রোগ নয় বলে জানানো হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তরফে। স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম জানিয়েছেন, গিলেন বেরি সিনড্রোম নতুন কোনও ধরনের বা বিরল কোনও রোগ নয়। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দেশে বা রাজ্যে নতুন কিছু নয়। মূলত অ্যাকিউট ফ্ল্যাসিড প্যারালাইসিসের কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত হন সাধারণত ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা।
গিলেন বেরি সিন্ড্রোমের প্রভাবে কী হতে পারে –
অসাড় হয়ে যাবে দেহ
সারা দেহে তীব্র যন্ত্রণা হবে
হাত ও পা ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করবে
১-৪ সপ্তাহের মধ্যে অসাড় হয়ে যাবে হাত-পা
ঘাড়ের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব পড়বে
৮শতাংশ রোগীর পায়ে দুর্বলতা আসে
মুখের পেশির দুর্বলতায় খেতে সমস্যা হবে
দুর্বল হতে শুরু করবে চোখের পেশিও
গিলেন বেরি সিনড্রোমের লক্ষণ কী –
কবজিতে ঝিনঝিন অনুভব হবে
হাত ও পায়ে দুর্বলতা
হাঁটা চলায় ভারসাম্য় হারাবেন
সিঁড়িতে ওঠানামা করতে অসুবিধে
দৃষ্টিতে সমস্যা হবে, মূলত ডবল ভিশন হবে
গা হাত পায়ে ব্যথা অনুভব হবে, যা রাতের দিকে বাড়বে
কথা বলা, খাবার চিবানো এবং গিলতে সমস্যা হবে
বুক ধড়ফড় করবে
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, এটি মূলত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শরীরের অ্যান্টিবডি বেড়ে গিয়ে তা শিরা উপশিরায় আটকে গেলে সেগুলিকে অচল করে দেয়। ক্যাম্পাইলভ ব্যক্টিরিয়া, জিকা ভাইরাস, করোনা ভাইরাসের জেরেও রোগীদের মধ্যে গুলেন বেরি সিনড্রোম দেখা গিয়েছে। যে কোনও ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। অ্যান্টিবডিগুলি মূলত প্রোটিনের একটা রূপ। নার্ভের ভিতরে যদি সেই প্রোটিন প্রবেশ করে এবং নার্ভের ভিতরে থাকা প্রোটিনের সঙ্গে সমতুল্য হয়ে যায়। তখন না বুঝেই অ্যান্টিবডিগুলো নার্ভে আটকে গিয়ে নার্ভগুলিকে অচল করে দেয়। তখনই নার্ভগুলো বিকল হতে শুরু করে।