মা-বাবার কথায় বিয়ে। তারপর ৭দিনের মধ্যে হানিমুনে গিয়ে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বামীকে খুন। দেশজুড়ে চর্চায় এই হানিমুন হত্যাকাণ্ড। ঘটনায় ইতিমধ্যে রাজা রঘুবংশীর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ৪জনকে ৭দিনের ট্রানজিট রিমান্ডে শিলং সদর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সোনম রঘুবংশীও রয়েছে সেখানে। মেঘালয়কে বদনাম করার চেষ্টা হয়েছে। সোনম সহ অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন মেঘালয়ের বাসিন্দারা। কেউ কেউ তো সোনমের ফাঁসির দাবিও জানাচ্ছেন।
মাম্পি রায়, সাংবাদিক- হানিমুন হত্যাকাণ্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। পুলিশ জানাচ্ছে, বিয়ের পর নিজের বাড়িতে এসেছিল সোনম। সেখানে বয়ফ্রেন্ড রাজ কুশওয়াহার সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজার খুনের ষড়যন্ত্র করেছিল। এই পুরো ঘটনাটা ঘটেছে কারণ সোনম রাজাকে সমস্ত সত্য খুলে বলতে পারেনি। আমাদের দেশে এটা একটা বড় সমস্যা যেখানে বিবাহ বা তার আগে প্রেমের বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারেন না অনেকে। এটাকে ভারতীয়দের সংস্কার বলতে পারেন আবার সমাজের বিধিনিষেধও বলতে পারেন।
এই নিয়ে ২০২০ সালে একটি সমীক্ষা হয়েছিল। যেখানে ৪৯ শতাংশ ছেলেমেয়ে বলেছিলেন বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তারা কথা বলতে পারেন না। অনেকে তো বলছেন বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতেও ভয় পান মা বাবার সঙ্গে। পরিবারের কাছে প্রেমের সম্পর্কের কথা লুকিয়ে রাখেন। এই ভয়ই পরবর্তীকালে বিয়ের সম্পর্ককে নষ্ট করে। এর পিছনে দায়ী সমাজের ভাবনাচিন্তা। ভারতের ৯৫শতাংশের বেশি মা-বাবা প্রেম করে বিবাহকে খারাপ মনে করেন। তাঁদের ধারণা তাঁদের ছেলেমেয়েও তাদের দেখা পাত্র বা পাত্রীকেই বিবাহ করবে। লাভ ম্যারেজ হলে সমাজে মাথা নীচু হয়ে যাবে, তাদের নিয়ে লোকে আলোচনা করবে। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনেও এমনটা হতে পারে। কারণ রাজা রঘুবংশীরও অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল।
সোনমের বয়ফ্রেন্ড রাজ কুশওয়াহার বয়স মাত্র ২০ বছর। সোনমের থেকেও ৫ বছরের ছোট এই রাজ কুশওয়াহা। সোনমের বাবার প্লাইউডের ফ্যাক্টরিতে কাজ করত সে। সোনম ভালো করেই জানত, তার বাবা কখনই সামান্য কর্মচারীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। আমাদের দেশে লাভ ম্যারেজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল- পরিবার ছেলে বা মেয়েটির জাতি, ধর্ম দেখেন। তারা আলাদা জাতি বা ধর্মের হলে তা মানতে চায় না পরিবার। এর উপর আবার রয়েছে ধনী গরিবের সমস্যাও। ধনীরা ধনীদের পরিবারেই বিয়ে দেন। ছেলেটি গরিব হলে সেই ঘরে মেয়ে দিতে চান না মেয়ের পরিবার। এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও এটা হতে পারে। তবে কি সোনমকে জোর করে রাজার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রশ্ন উঠছে। কারণ সোনমের বাবা আগে জানিয়েছিলেন, তিনি রাজ কুশওয়াহাকে চেনেন না। কিন্তু রাজা রঘুবংশীর শেষকৃত্যে সোনমের বাবার সঙ্গে দেখা গিয়েছে মূল অভিযুক্ত রাজ কুশওয়াহাকে। ইন্দোরের ক্রাইম ব্রাঞ্চ পরিবারের সঙ্গে কথা বলবে, সোনম নিজের প্রেমের সম্পর্কের কথা রাজার কাছে কেন লুকিয়ে রাখল, তাও জানার চেষ্টা করবে পুলিশ। সোনম যদি সবটা আগেই রাজাকে পরিষ্কার জানাতো তাহলে রাজা তাকে বিয়ে করতেন না। এই হত্যাকাণ্ড ঘটত না। এখানে সোনমের মানসিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, যেখানে একদিকে রাজাকে বিয়ে করছেন সোনম, আবার তাকে হত্যার পরিকল্পনা করল।
আপনার চারপাশে একাধিক রাজাও থাকতে পারে আবার সোনমও থাকতে পারে। এধরণের ঘটনার থেকে কীভাবে বাঁচবেন দেখে নিন
১. সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রয়োজন। বিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হচ্ছে মনে হলে সেক্ষেত্রে পাত্র বা পাত্রীকে সব সত্যি কথা খুলে বলতে হবে। শেষটা যেমনই হোক, কিন্তু কখনই কোনও মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে সম্পর্ক শুরু করা উচিৎ নয়।
২. বিয়ের সিদ্ধান্তে তাড়াহুড়ো করা উচিৎ নয়। বিশেষ করে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে একে অপরকে জানতে সময় নেওয়া উচিৎ। রাজার পরিবার জানাচ্ছে বিয়ের আগে রাজার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হত না সোনম। অর্থাৎ রেড ফ্ল্যাগ থাকলেও, তা বুঝতে পারেননি রাজা বা তার পরিবার।
৩. ছেলে বা মেয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড খতিয়ে দেখা উচিৎ। আগে বিয়ের সম্বন্ধ হলে, তার পরিবার কেমন সেই সংক্রান্ত সমস্ত খবর খুঁজে বের করা হত। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগ। প্রচুর ম্যাট্রিমনি অ্যাপের মাধ্যমেও বিয়ে হচ্ছে। সেখান থেকে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স দেখেই বিয়ে পাকা করা হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। মেঘালয় হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত সোনমের বয়ফ্রেন্ড রাজ কুশওয়াহা তার বাবার প্লাইউডের ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। রাজা বা তার পরিবার যদি সোনমের বিষয়ে ঠিকঠাক খবর নিত তাহলে হয়তো এই পরিণতি হত না। কাউকে চাকরিতে নিয়োগ করতে গেলেও কতরকমভাবে তার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হয়। এইচআর ডিপার্টমেন্ট কত ফোন করেন, ঘরে পরিচারিকা রাখতে হতেও তো কত খবর নেওয়া হয় তাহলে বিয়ের ক্ষেত্রে এভাবে খবর নেওয়া হচ্ছে না কেন ?
৪. বিয়ের জন্য ছেলে বা মেয়েকে জোর করবেন না। আমাদের দেশে মা-বাবারা ছেলে মেয়েদের অনেকসময় বিয়ের জন্য জোর করে থাকেন। যার পরিণাম এমনই ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাই সন্তানের পছন্দকে সম্মান করতে হবে।
৫. অদ্ভুত ব্যবহার দেখলে কখনও এড়িয়ে যাবেন না। তা সে বিয়ের আগে হোক বা বিয়ের পরে। সোনমও বিয়ের আগে রাজার সঙ্গে দেখা করতে চাইতো না। সোনম দেখাত যেন সে কোনও কারণে বিরক্ত বোধ করছে। রাজার পরিবার মনে করত, সোনম হয়তো ক্লান্ত বলে এমন ব্যবহার করছে। মা বাবা না হলেও অন্তত একজন বন্ধুকে মনের কথা বলতে হবে। যে মানসিকভাবে পাশে থাকবে। সোনমের ক্ষেত্রে বোধহয় এমনটা ছিল না। মনের কথা বলার লোক ছিল না।
জানা যাচ্ছে যে কুড়ুল দিয়ে রাজার হত্যা করা হয়েছে, সেটি অনলাইনে কেনা হয়েছিল। সোনম শিলংয়ে যেখানে ছিল, তার মাত্র ১ কিলোমিটার দূরেই ছিল মূল অভিযুক্তরা। সোনম ক্রমাগত নিজের লাইভ লোকেশন পাঠাচ্ছিল তাদের। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে কতটা পরিকল্পনা করে মাত্র ৭ দিনের বিয়ে করা স্বামীকে খুন করেছে বা করিয়েছে সোনম। সোনমের চরিত্র নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনই প্রশ্ন উঠছে সোনমের পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে। তারা যদি জোর করে সোনমের বিয়ে দিয়ে থাকেন, তার খেসারত দিতে হল ২৯ বছর বয়সী রাজা রঘুবংশীকে।