আগের প্রতিবেদনে পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের নানা রহস্য নিয়েই আলোচনা যেখানে শেষ করেছিলাম, আজ সেখানেই শুরু করছি।
প্রবীর মুখার্জী, সাংবাদিক- পবিত্র নিম গাছে কাঠ দিয়ে তৈরি হওয়া জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতি ৮ বা ১২ বা ১৯ বছর অন্তর বদল হয়ে থাকে। কোন বছরের আষাঢ় মাস যদি মল মাস হয়। সেই বছরে নব কলেবর হয়ে থাকে। অর্থাৎ আষাঢ় মাসে যদি দুটি পূর্ণিমা বা দুটি অমাবস্যা থাকে, তবে সেই আষাঢ়কে বলা হয় মলমাস। বৈষ্ণবদের কাছে এই মাসটি শুদ্ধ মাস বলে ধরে নেওয়া হলেও, সেই আষাঢ় মাসে কিন্তু রথযাত্রা হয় না। জগন্নাথ দেবের নতুন মূর্তি গড়ে সেখানে প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর পুরনো মূর্তিটি কইলি বৈকুন্ঠের কাছে সমাধিস্থ করা হয়। আরও আশ্চর্যের বিষয় নবকলেবরের জন্য যে গাছটি নির্বাচিত করা হয়, সেটি মন্দির কর্তৃপক্ষের দ্বারা নির্ধারিত কাঠুরে একেবারে গোপনে ২১ দিন ধরে কাটেন।
মূর্তি বদলের সময়েও রয়েছে রহস্য। নবকলেবরের সময়ে জগন্নাথ দেবের নতুন মূর্তিতে যখন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন মন্দির চত্ত্বরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। মন্দির চত্ত্বরে মোতায়েন করা হয় কেন্দ্রীয় বাহিনী। বয়োঃজ্যেষ্ঠ পুরোহিত চোখ বাঁধা অবস্থায় পুরনো মূর্তির বুক থেকে হৃদয় নিয়ে তা স্থাপন করেন প্রভুর নতুন মূর্তিতে। কিন্তু, তিনি শুধুমাত্র অনুভব করতে পারলেও তা দেখতে যেমন পারেন না, তেমনই সেই অনুভূতিও ব্যক্ত করতে পারেন না। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি অপ্রকট হয়ে যান বলে কথিত।
মন্দিরের চূড়ায় যে চক্র আমরা দেখতে পাই , ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, যে কোনও অ্যাঙ্গেল থেকেই আপনি দেখুন না কেন, মনে হবে চক্রটি আপনার দিকেই ঘোরানো। শুধু তাই নয়, এক টন ওজনের এই চক্রটি প্রায় ৮০০ বছর আগে কীভাবে মন্দিরে অত উঁচুতে তোলা হয়েছিল তা বিষ্ময়ের বৈকি। সেই সময়ে প্রযুক্তি কিন্তু অতটাও উন্নত হয় নি।
পুরীর জগন্নাথদেব মন্দিরের রান্নাঘর নিয়ে তো আগেই বলেছি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রান্নাঘর এটাই। সেখানেও রয়েছে রহস্য। পর পর ৭টি পাত্র বসিয়ে কাঠের জ্বালে রান্না করা হয়। কিন্তু, সবার আগে রান্না হয় সবচেয়ে উপরের পাত্রটিতে। কীভাবে ….। তার উত্তর আজও সবাই খোঁজেন। আরও আশ্চর্যের। প্রভু জগন্নাথদেবের প্রসাদ যদি ২ হাজার মানুষ গ্রহণ করেন তাও উচ্ছিষ্ট হবে না। আবার ২০ হাজার মানুষও যদি গ্রহণ করেন, প্রসাদ কখনও কম পড়বে না। কিন্তু, কী ভাবে….। জানা নেই। তবে বিশ্বাস স্বয়ং মা লক্ষ্মী এসে নাকি তাঁর স্বামীর জন্য ভোগ রান্না করে দিয়ে চলে যান। আবার রথের পর উল্টোরথ পর্যন্ত যে হেতু প্রভু তাঁর ভাই বোনেদের নিয়ে মাসীর বাড়ি যান, তাই রাগ করে মন্দিরে আসেন না মা লক্ষ্মী। উল্টোরথের পর স্বয়ং জগন্নাথ দেব এসে তাঁর মানভঞ্জন যতক্ষণ না করছেন, ততক্ষণ রান্নাঘরে প্রবেশ করেন না লক্ষ্মীদেবী।
মন্দিরের ভিতরে প্রবেশের পর আপনি কিন্তু আর সমুদ্রের কোনও গর্জন শুনতে পাবেন না। কথিত , সুভদ্রা দেবী মন্দিরের ভিতরে নীরবতা বজায় রাখার জন্য বায়না করেছিলেন দাদা জগবন্ধুর কাছে।
রহস্য আরও রয়েছে। উপকূলবর্তী এলাকায় দিনের বেলায় সমুদ্র থেকে স্থলের দিকে এবং রাতে স্থল থেকে জলভাগের দিকে অর্থাৎ সমুদ্রের দিকে হাওয়া চলে। পুরীর জগন্নাথ দেব মন্দিরের কাছে দিনের বেলায় স্থল থেকে সমুদ্রের দিকে এবং রাতের বেলায় সমুদ্র থেকে স্থলের দিকে হাওয়া চলে। এসবকিছুই যদি প্রত্যক্ষ করতে হয়, তবে আপনাকে সরেজমিনে একবার যেতেই হবে পুরীতে। আর দর্শন করতে হবে জগন্নাথদেবকে। এতদূর যাবেন যখন, প্রসাদও গ্রহণ করবেন। আর পরিশেষে জগন্নাথদেবের নামে জয়ধ্বনিও করবেন।