উচ্চ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বসবাস ছিল ইরানে। তখনও স্বতন্ত্র ভাবনাচিন্তা ছিল ইরানের মানুষজনের। রাজধানী তেহরান সহ বিভিন্ন শহরে হিজাব ছাড়াই যেতে পারতেন ইরানের মহিলারা। স্বাভাবিক পোশাক পরেই বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারতেন তাঁরা। কিন্তু বর্তমানে পাবলিক প্লেসে যেতে গেলেই মহিলাদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। ধার্মিক কট্টরপন্থাও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে ইরানে।
মাম্পি রায়, সাংবাদিক- ইরান-ইজরায়েলের যুদ্ধে বারবার হুমকি হুঁশিয়ারির সুর শোনা যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গলায়। সব সমস্ত হুমকি ইরানকে লক্ষ্য করেই দেয় আমেরিকা। কারণ ইজরায়েল-আমেরিকা যে বন্ধু। অন্যদিকে ইজরায়েল-আমেরিকা ঘোর শত্রু ইরানের। তবে সর্বদা ছবিটা এমন ছিল না। ইরান সবসময় আমেরিকা-ইজরায়েলের শত্রু ছিল না। ১৯৪৮ সালে যখন ইজরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন তুরস্কের পর ইরান প্রথম মুসলিম দেশ ছিল, যে ইজরায়েলকে সমর্থন করেছিল। তখন ইজরায়েল এবং ইরানের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সেইসময় ইরান, ইজরায়েল এবং আমেরিকা দুজনেরই বন্ধু ছিল। যদিও বর্তমানে দুজনেই ইরানের শত্রু। এছাড়া ওইসময় ইরান ছিল সংস্কারমুক্ত, উদার। উচ্চ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বসবাস ছিল ইরানে। তখনও স্বতন্ত্র ভাবনাচিন্তা ছিল ইরানের মানুষজনের। রাজধানী তেহরান সহ বিভিন্ন শহরে হিজাব ছাড়াই যেতে পারতেন ইরানের মহিলারা। স্বাভাবিক পোশাক পরেই বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারতেন তাঁরা। কিন্তু বর্তমানে পাবলিক প্লেসে যেতে গেলেই মহিলাদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক। ধার্মিক কট্টরপন্থাও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে ইরানে। সময় যত পেরোয় কোনও দেশ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও উন্নত হয়।
কিন্তু ইরানে ছবিটা একেবারে অন্য। ১৯৭৯ সালের আগের ইরানের সঙ্গে তার পরের ইরানে ধর্মীয় কট্টরপন্থা বেড়েছে কয়েক গুণ। বেড়েছে মহিলাদের উপর বিধিনিষেধ চাপানোর প্রবণতাও। ১৯৭৯-সালের আগে ইরানের ইজরায়েল ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল। তার পরে সম্পর্কের অবনতি হয়। ওই বছরেই ইরানে ইসলামিক বিপ্লব ঘটেছিল। ইসলামিক বিপ্লবের আগে রাজশাহী শাসন ছিল ইজরায়েলে। ইরানের রাজা ছিলেন শাহ মহম্মদ রজা পহলভি। ইজরায়েল ও আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন তিনি। ইরানে শাহের শাসনের প্রথমদিকে তেমন কোনও সমস্যা হয়নি। শেষের দিকে শাহের বিরোধিতা করতে শুরু করেন ইসলামিক কট্টরপন্থীরা। তাঁদের ধারণা ছিল, ইরানের তেল ভান্ডারের থেকে নিজের পকেট ভরছেন শাহ মহম্মদ রজা। ইসলামিক রীতি রেওয়াজকে নষ্ট করে দিচ্ছেন তিনি। ধর্মবিরুদ্ধ কাজ করছেন এবং আমেরিকার থেকে প্রভাবিত হয়ে ইরানের সংস্কৃতিকে জলে মিশিয়ে দিচ্ছেন। এই কারণের জেরেই ইসলামিক বিপ্লব ঘটে যায়। তারপরই ইরানের প্রধান নেতা হিসেবে উঠে আসেন রুহুল্লা খামেনেই। ইরানের ক্ষমতাচ্যুত রাজা – শাহ মহম্মদ রজা পহেলভি প্রাণ বাঁচাতে প্রথমে ইজিপ্ট, পরে আমেরিকায় আশ্রয় নেন। তড়িঘড়ি ইরান না ছাড়লে প্রাণে বাঁচতে পারতেন না শাহ। ওইসময় থেকেই আমেরিকার প্রতি ক্ষোভ বাড়তে থাকে ইরানের। ইরানের মানুষ মনে করতেন, যে রাজাকে ইরান শাস্তি দিতে চেয়েছিল, তাকে প্রাণে বাঁচাল আমেরিকা। অর্থাৎ আমেরিকা ইরানের শত্রু। এই ক্ষোভের বশে ১৯৭৯ সালের চৌঠা নভেম্বর, তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায় প্রায় ৪০০ ইসলামিক বিপ্লবী। ৮৬জন মার্কিনি এবং তাঁদের পরিবারকে বন্দি বানিয়ে রাখা হয়। রুহুল্লা খামেনেই আমেরিকাকে শর্ত দেন, বন্দিদের মুক্তি চাইলে আগে শাহ মহম্মদ রজা পহেলভিকে ইরানের হাতে ছাড়তে হবে। আমেরিকাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে ইরান। যাতে করে গোটা বিশ্বের সামনে আমেরিকার সুপারপাওয়ার ইমেজ মুখ থুবড়ে পড়ে। তারপর ইরানের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা চাপায় আমেরিকা। আমেরিকা জানায়, যে দেশ ইরানের থেকে কাঁচা তেল কিনবে, সেই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আমেরিকা। এই নিষেধাজ্ঞার জেরে গোটা বিশ্বে একঘরে হয়ে যায় ইরান, তবুও ইরান মাথা নোয়ায়নি। বন্দিদের মুক্তি দেয়নি তারা। তবে মহিলা বন্দিদের ছেড়ে দিয়েছিল ইরান। ৬মাস পর বন্দিদের ছাড়ানোর জন্য নিজেদের ৮টি হেলিকপ্টার ইরানে পাঠায় আমেরিকা। এর মধ্যে ৩টি হেলিকপ্টার খারাপ হয়ে যায়। বাকি কপ্টারগুলি অপারেশন না চালিয়েই আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছিল, তখনই একটি কপ্টার আমেরিকার একটি বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়। তারপরই আমেরিকার শক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমেরিকা কি আদৌ এতটা শক্তিশালী, যতটা তারা নিজেদের দাবি করে ? সেই প্রশ্নও উঠে যায়। ২৭ জুলাই ১৯৮০ সালে যখন শাহের মৃত্যু হয়, তখন আমেরিকা ভেবেছিল রজার মৃত্যুর পর এবার বোধহয় বন্দি মার্কিনীদের ছেড়ে দেবে ইরান। কিন্তু তারপরও বন্দিদের ছাড়া হয়নি। পরে শোনা যায় ইরানের প্রতিবেশী দেশ ইরাকের থেকে সাহায্য নেয় আমেরিকা। ইরাকের সর্বোচ্চ নেতা সাদ্দাম হোসেন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। প্রায় ৮ বছর চলেছিল সেই যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে জয়ী হয় ইরান। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যুদ্ধ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে ইরানের। তারপর দেড় বছর পর আমেরিকার বন্দিদের মুক্তি দেয় ইরান। ওই দেড় বছরেও একাধিকবার বন্দিদের মুক্ত করার চেষ্টা করেছিল আমেরিকা, কিন্তু পারেনি। যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যান এবং ক্ষমতায় আসেন রোনাল্ড রিগান, তখন ওই বন্দিদের মুক্তি দেয় ইরান। সুতরাং ইরান ও আমেরিকার সম্পর্কে তিক্ততার শুরু অনেক আগেই থেকেই। বর্তমানেও বহাল দুই দেশের সম্পর্কের সেই তিক্ততা। একে অপরকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না এই দুই দেশ। ক্ষমতায় বহাল থাকার জন্য আমেরিকার প্রতি এই ঘৃণাকে আরও বেশি করে ব্যবহার করেন খামেনেই। গোটা বিশ্বের সামনে ইরান এটা প্রমাণ করতে চায় যে, মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে ইরান একাই এমন একটা দেশ, যে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে এবং আমেরিকার সামনে মাথা নোয়াতে একেবারেই রাজি নয়। সৌদি আরব, কাতার, জর্ডন ও তুরস্কের মতো দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে আমেরিকার। এইসব দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। যা ওইসব দেশের সরকারের সম্মতিতেই স্থাপন করেছে আমেরিকা। সেজন্যই ইরান জোর গলায় বলতে পারে যে, মধ্যপ্রাচ্যে তারাই একমাত্র দেশ, যারা আমেরিকার চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে পারে। এইসবকিছু ধার্মিক কট্টরপন্থার মাধ্যমেই করে ইরান।
আমেরিকার প্রতি এই ঘৃণার যথেষ্ট মূল্য চোকাতে হয়েছে ইরানকে। ভেনেজুয়েলা এবং সৌদি আরবের পর কাঁচা তেলের সবচেয়ে বড় ভান্ডার রয়েছে ইরানে। কিন্তু আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনও দেশকে তেল বিক্রি করতে পারে না ইরান। অর্থাৎ তেল থাকলেও তা বেচতে পারে না, তেল থাকলেও টাকা নেই। যে তেল বিক্রি করে ইরান ধনী হতে পারত, সেই তেল ইরানের কোনও কাজেই আসছে না। তবে ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চিন। কাঁচা তেলের মতো প্রাকৃতিক গ্যাসের সবচেয়ে বড় ভান্ডারও রয়েছে রাশিয়ায়। তারপরই রয়েছে ইরানের স্থান। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রাকৃতিক গ্যাসও বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে পারে না ইরান। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের এয়ারলাইন্স নতুন অসামরিক বিমান কিনতে পারে না। বাধ্য হয়ে পুরনো বিমানই ব্যবহার করতে হয় ইরানের এয়ারলাইন্সকে। ইরান এয়ারলাইন্সের ৬০ শতাংশ বিমান আউটডেটেড। বাকি বিমানগুলির অবস্থাও ঝরঝরে। সেজন্যই প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয় বিমানগুলিকে। ১৯৮০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিমান দুর্ঘটনার কবলে প্রায় ১৮০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। একইভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জেরে বায়ুসেনার জন্যও ভালো যুদ্ধবিমান কিনতে পারে না ইরান। সেজন্য খুবই খারাপ অবস্থা ইরানের যুদ্ধবিমানগুলির। সেই কারণেই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও নিজেদের যুদ্ধবিমানের খুব একটা বেশি প্রয়োগ করছে না ইরান। কারণ তাদের কাছে আধুনিক যুদ্ধবিমান নেই। ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের আগে অর্থাৎ ১৯৭৯ সালের আগে বিশ্ব মানচিত্রে ইরানের অর্থব্যবস্থা ছিল ১৯ নম্বরে। ২০২৫ সালে সেই ইরান চলে এসেছে ৪৫ নম্বরে। এর থেকেই স্পষ্ট আমেরিকার সঙ্গে শত্রুতার কতটা ঠিক মূল্য দিতে হল ইরানকে। এখনও তার রেশ চলছে।