রথযাত্রা মানেই যেমন দুর্গাপুজোর জন্য সাজো সাজো রব। তেমনই আষাঢ় মাসের গুপ্ত নবরাত্রির ব্রত পালনের সময়। তেমনই আবার বিপত্তারিণীর পুজো। আসুন আজ জেনে নেওয়া যাক কী এই পুজো। কীভাবেই বা এই পুজো করা যেতে পারে। কারা করতে পারে এই পুজো।
সাংবাদিক, প্রবীর মুখার্জী : রথ ও উল্টোরথের মাঝে শনি ও মঙ্গলবার বিপত্তারিণীর পুজো হয়ে থাকে। খুব বেশী আচার অনু্ষ্ঠানের ব্যপার না থাকলেও কয়েকটি বিশেষ নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হয় এই পুজোর জন্য। এই নিয়মই অন্য সমস্ত পুজোর থেকে একেবারে আলাদ করে রেখেছে বিপত্তারিণী পুজোকে। প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক কে এই বিপত্তারিণী। বিপদ থেকে যিনি উদ্ধার করেন । তিনি বিপত্তারণ। আর স্ত্রী লিঙ্গ যদি কেউ উদ্ধার করেন , তবে তা বিপত্তারিণী। এখানে দেবী বিপত্তারিণী হলেন মহাশক্তি। তিনি কালীমাতাও হতে পারেন। আবার দুর্গা মাতাও হতে পারেন। আবার শৈলপুত্রীও হতে পারেন। হতে পারেন দক্ষকন্যা বা কাত্যায়ণী। অর্থাৎ তিনি চতুর্ভুজা-দশভুজা-অষ্টাদশভুজা বা দ্বিভুজাও হতে পারেন। তিনি মহাশক্তি। শিবের ঘরণী পার্ব্বতী। সাধারণত কালী মন্দিরেই গিয়েই এই পুজো দেওয়া হয়ে থাকে। পুজোর দিন অর্থাৎ রথ ও উল্টোরথের মাঝে শনি বা মঙ্গলবার যেকোনও একটি দিন বেছে নিয়ে পুজো দেওয়া হয়। ব্রত পালনের আগের দিন নিরামীষ আহার করতে হয়। ব্রত পালনের দিন সকালে স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্রে মন্দিরে গিয়ে পুজো নিবেদন করা হয়ে থাকে।
গ্রাম বাংলায় এই পুজো সবচেয়ে বেশি প্রচলিত হলেও শহরাঞ্চলের পুরোন বাসিন্দারা অনেকেই এখনও এই ব্রত পালন করে থাকেন। ১৩টি ফুল, ১৩টি ফল, লাল সুতোয় ১৩ টি গিঁট যা ১৩টি দুর্বা দিয়ে আলাদা আলাদা করে বাঁধতে হয়। এছাড়াও ১৩টি পান ও ১৩টি সুপারি। অবশ্যই লাল জবা ফুল। ইচ্ছা হলে একটি পদ্ম এবং বেলপাতা দিয়েও পুজো দিতে পারেন। সেখানে পুস্পাঞ্জলী দিয়ে বাড়িতে এসে দুপুরে একবার মাত্র বসে আহার করতে পারবেন। পুজো দেওয়ার পর হাতে লাল সুতো যা ১৩টি দুর্বা দিয়ে ১৩টি গিঁট দিয়ে বাঁধা। ওই লাল সুতো নিজে এবং পরিবারের সকলকে পরতে পারেন। পুরুষরা ডান হাতে এবং স্ত্রীলোক বাঁ হাতে পরে থাকেন।
মনে রাখবেন, এই দিনে কিন্তু, অন্ন গ্রহণ নিষিদ্ধ। সাধারণত ১৩ টি লুচি, নানা তরকারি, ভাজা এবং মিষ্টি দিয়ে ভোজন করতে হয়। দুপুরে খাবার সময়ে কথা বলা যাবে না। কথা বললেই কিন্তু আর খেতে পারবেন না। রাত্রে খুব ক্ষিদে পেলে দাঁড়িয়ে ফল মিষ্টি ছানা গ্রহণ করতে পারেন। পরদিন সকালে স্নান সেরে দেবীকে স্মরণ করে ব্রত ভঙ্গের নিয়ম। আষাঢ় মাসে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া থেকে শুরু করে দশমী তিথি পর্যন্ত অনেক গ্রামেই বিপত্তারিণী দেবীর পুজো হয়ে থাকে। তবে আষাঢ় যদি মলমাস হয়, সেক্ষেত্রে শ্রাবণ মাসে পালিত হয় বিপত্তারিণীর পুজো।
সংসারের সকলের মঙ্গল কামনার্থে এবং বিপদ থেকে সংসারের সকলকে রক্ষা করার উদ্দ্যেশ্যেই এই পুজোর আয়োজন। সাধারণ হিন্দু ঘরের মহিলারাই এই ব্রত পালন করে থাকেন। ইচ্ছা হলে আপনি মন্দিরে না গিয়ে বাড়িতেও এই পুজোর আয়োজন করতে পারেন। উপরোক্ত পুজোর উপকরণের সঙ্গে একটি ঘট , আম্রপল্লব ও শীষওয়ালা একটি ডাবের প্রয়োজন। ইচ্ছা থাকলে মায়ের জন্য একটি সিঁদুর আলতা শাঁখা পলাও দিতে পারেন। স্নান সেরে শুদ্ধ চিত্তে, গঙ্গা মাটির উপর জল ঢেলে একটু নরম করে তার উপর ঘট বসান। ঘট কিন্তু গঙ্গাজল দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। এরপর একটি বেল পাতায় সিঁদুর তেল মিশিয়ে ঘটে স্বস্তিক চিহ্ণ এঁকে নিন। আম্রপল্লবেও ওই সিঁদুর ছুঁয়ে নিন। এরপর শীষওয়ালা ডাবেও স্বস্তিক চিহ্ণ এঁকে নিন। শীষের মধ্যে দেবীকে স্মরণ করে শাঁখা-পলা পরিয়ে দিন। এবার দেবীর উদ্দ্যেশ্যে ফল ও ফুল নিয়ে আসন পেতে বসুন পুজো করতে। দেবীকে স্মরণ করুন। দু-হাত জোড় করে নিম্ম লিখিত মন্ত্রোচ্চারণ করুন।
বিপত্তারিণী পুজোর মন্ত্র..
মাসি পূণ্যতমেবিপ্রমাধবে মাধবপ্রিয়ে।
ন বম্যাং শুক্লপক্ষে চবাসরে মঙ্গল শুভে।।
সর্পঋক্ষে চ মধ্যাহ্নেজানকী জনকালয়ে।
আবির্ভূতা স্বয়ং দেবীযোগেষু শোভনেষুচ।।
সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বক্যে গৌরী নারায়ণী নমোহস্তুতে।।
সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানং শক্তিভুতে সনাতনী
গুণাশ্রয়েগুণময় নারায়ণী নমোহস্তুতে।।
শরণাগতদীনার্ত পরিত্রাণপরায়ণে।
সর্ব্বস্যার্তিহতে দেবী নারায়ণী নমোহস্তুতে।।
সর্বস্বরূপেসর্ব্বেশে সর্বশক্তিসমন্তিতে।
ভয়েভ্যস্ত্রাহিণোদেবী দুর্গেদেবী নমহোস্তুতে।।