মাম্পি রায়, সাংবাদিক- ১ জুন, বড়সড় হামলা চালানো হয় রাশিয়ায়। যেখানে ৪টি এয়ারবেস এবং ৪১টি বিমানকে নিশানা করা হয়েছে। ৪টি এয়ারবেসের মধ্যে একটি ইউক্রেনের সীমান্ত থেকে ৪,৩০০ কিলোমিটার দূরে। দ্বিতীয়টি ১৮০০ কিলোমিটার দূরে। তৃতীয়টি ৮০০ কিলোমিটার দূরে। চতুর্থ এয়ারবেস ৫২০ কিলোমিটার দূরে। এই প্রথমবার রাশিয়ার এতটা ভিতরে ঢুকে হামলা চালাল ইউক্রেনের ড্রোন। যা কার্যত কল্পনাতীত। ইউক্রেনের অর্ধেক দাবি সত্যি হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটা প্রথম হামলা যেখানে কোনও দেশ প্রতিপক্ষ দেশের ৪হাজার কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে এয়ারবেস এবং সেখানে থাকা বিমানে হামলা চালাল।
ইউক্রেন কীভাবে রাশিয়ার এতটা ভিতরে ঢুকে হামলা চালাল ? তা ভেবেই হতবাক গোটা বিশ্ব। আসলে প্রথাগতভাবে এই হামলা চালানো হয়নি। ইউক্রেন জানাচ্ছে, তারা ১১৭টি কমব্যাট ড্রোনের একটি ইউনিট বানিয়েছিল। যা রফতানিতে ব্যবহার হওয়া ট্রাকের মাধ্যমে রাশিয়ার ভিতরে প্রবেশ করানো হয়েছে। মূলত খাবার সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছয় এমন ট্রাককেই ড্রোন প্রবেশ করানোর জন্য বেছে নেওয়া হয় এই মিশনে। সংশ্লিষ্ট এয়ারবেসের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়া হয় সেইসব ট্রাকগুলিকে। তারপরই নির্দিষ্ট নিশানায় হামলা চালায় ড্রোনগুলি। অর্থাৎ এমন ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছে, যার উপর কেউ সন্দেহ করবে না। রাশিয়া যাতে সন্দেহ না করে সেজন্য কাঠের বাক্সে করে কমব্য়াট ড্রোনগুলিকে লুকিয়ে রাখা হয়। এই ড্রোনগুলিকে নিয়ে রাশিয়ার সীমায় হাজির হয় ট্রাকগুলি। তারপর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে গিয়ে হামলা চালায়। একেবারে নতুন ধরণের রণনীতি নিয়েছে ইউক্রেন তা বলাই বাহুল্য। সীমান্ত থেকে ট্রাকগুলি ইউক্রেনের হামলাকারী ড্রোন নিয়ে ৪হাজার কিলোমিটার ভিতরে প্রবেশ করল কী করে ? সেক্ষেত্রে অনেকেই মনে করছেন রাশিয়ার ভিতর থেকেই কেউ হামলার পিছনে কলকাঠি নেড়েছে।
যে ট্রাক ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ড্রোনগুলি নিয়ে রাশিয়াতে এনেছে, সেই ট্রাকচালকের এই কাজ করতে অন্তত ৩ থেকে ৭ দিন সময় লেগেছে। অর্থাৎ এতদিন ড্রোনগুলি ট্রাকের ভিতরে থাকল। আর চালকও ট্রাকগুলি নিয়ে কত সহজে রাশিয়ার সবচেয়ে সংবেদনশীল এয়ারবেসে নিয়ে চলে গেলেন এবং তা জানতেও পারলেন না। রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থাও এবিষয়ে কিছুই জানতে পারল না, সেইসব নিয়ে প্রশ্নও উঠছে। ইউক্রেন দাবি করেছে, এই ট্রাকের মাধ্যমে ড্রোনগুলিকে প্রথমে তারা রাশিয়ার এয়ারবেসগুলির কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে এক বা দুজন ড্রোন অপারেটর রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে কাঠের বাক্সের ঢাকনা খুলে দেয়। তারপর ড্রোনগুলি হামলার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে উড়ে যায়। ৪টি এয়ারবেসের ৪১টি বিমানকে ধ্বংস করে দিয়েছে ইউক্রেনের ওই ড্রোন। যারা ভাবছেন, রাশিয়ার এস-৪০০, এস-৫০০-র মতো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এই হামলাকে রুখতে পারল না কেন ? তার উত্তর হল আকাশ থেকে মিসাইল উড়ে এলে তার জবাব দিতে পারত রাশিয়ার এই ডিফেন্স সিস্টেম। কিন্তু যেহেতু হামলাকারী ড্রোনগুলি আর ৫দিনের মধ্যে সীমান্ত থেকে রাশিয়ায় ঢোকা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ট্রাকের মতোই ঢুকেছে, স্মাগলিনের মাধ্যমে হামলা হয়েছে সেজন্যই কারোর সন্দেহ হয়নি।
ইউক্রেন জানাচ্ছে এই হামলায় তারা ১১৭টি এফপিভি বা ফার্স্ট পার্সন ভিউ ড্রোন ব্যবহার করেছে। যা সুইসাইড ড্রোন হিসেবেও পরিচিত। যে ড্রোনগুলি ভিডিও বানানোর কাজে ব্যবহার করা হয়, ওই ড্রোনের মতোই এই হামলাকারী ড্রোনগুলিকেও একজন ব্যক্তি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে ওড়ায়। ড্রোনের ২০ কিলোমিটারের মধ্যেই থাকতে হল ওই অপারেটরকে। অর্থাৎ শুধুমাত্র ট্রাকের মাধ্যমে এই ড্রোনকে রাশিয়ায় ঢোকানো হয়েছে, তাই নয়। হামলাকারী ড্রোন অপারেটরও রাশিয়ার ঢুকেই কাজ চালাচ্ছিল। ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি করেছেন, তাঁর স্পাইডার্স ওয়েব অপারেশনের সমস্ত অপারেটর সুস্থভাবে ফিরে এসেছেন। মাকড়সা যেভাবে জাল বানায়, সেই জালে পোকামাকড় আটকে যায় এবং পালাতে ব্যর্থ হয়। ঠিক সেভাবেই জাল বানিয়ে রাশিয়াকে ফাঁসিয়েছে ইউক্রেন। এভাবেই এত বড় হামলা করা হয়েছে। সেজন্যই এই হামলার নাম দেওয়া হয়েছে স্পাইডার্স ওয়েব। এই হামলায় ইউক্রেনের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে বিশ্বের বহু দেশ। ইউক্রেন দাবি করছে এই ড্রোন হামলার মাধ্যমে রাশিয়ার ৪১টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে তারা। প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যদিও রাশিয়ার দাবি এই হামলা হয়েছে, কিন্তু তাতে এমনকিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইউক্রেন মিথ্যা দাবি করছে বলেও জানাচ্ছে রাশিয়া। একদিকে ইউক্রেন জানাচ্ছে, তাদের হামলাকারী ড্রোনের সমস্ত অপারেটর সুরক্ষিতভাবে দেশে ফিরে এসেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার দাবি, ড্রোনের অপারেটরদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ইউক্রেন ও পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, ইউক্রেন রাশিয়ার বোমারু বিমান এবং এয়ার বম্ব কম্যান্ড সেন্টারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এর মধ্যেও যে এয়ার বম্ব কম্যান্ড সেন্টার আছে, তাকে এ-৫০ বলা হয়, এর মূল্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। নিউক্লিয়ার বম্বার বিমানকে বলা হয় টিইউ-৯৫। যার আনুমানিক মূল্য ৪৩০ কোটি টাকা। স্ট্র্যাটেজিক বিমানকে বলা হয় টিইউ-২২এম। যার মূল্য ৬০০ কোটি টাকা। এটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমারু বিমান, যা এই ড্রোন হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করেছে ইউক্রেন। যদিও সমস্তটাই অস্বীকার করেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি করছেন, এই হামলার জন্য গত দেড় বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের সেনা। এর থেকেই স্পষ্ট শান্তিবার্তার পাশাপাশি হামলার পরিকল্পনাও চালাচ্ছিল ইউক্রেন। মঙ্গলবারও তুরস্কের ইস্তানবুলে শান্তিবার্তার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার প্রতিনিধিমণ্ডলের সদস্যদের। দুইদেশই এবিষয়ে সহমত হয়েছে যে, এক হাজার করে যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেবে তারা। গত সপ্তাহেও একইভাবে তারা যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিয়েছে। এরইমধ্যে ইউক্রেনের এহেন ড্রোন হামলা।
দেশের মানুষ যুক্ত না থাকলে ইউক্রেন থেকে হামলাকারী ড্রোন রাশিয়ার ভিতরে কোনওভাবেই ঢুকতে পারত না, এটাও স্পষ্ট। রাশিয়া স্পষ্ট জানিয়েছে, এই হামলার বদলা তারা নেবেই। পাশাপাশি রাশিয়ার ভিতর থেকে যারা এই হামলায় সাহায্য করেছে, তাদেরকেও বেছে বেছে শাস্তি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুতিনের প্রশাসন।
এর আগে রাশিয়া যখন ইউক্রেনের উপর এমন আক্রমণ চালাত তখন পশ্চিমি দেশগুলি আর্থিক প্রতিবন্ধকতা লাগাত, সবসময় এর সমালোচনা হত, রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘে নতুন নতুন প্রস্তাব আনা হত। অথচ যখন ইউক্রেন হামলা চালাল, এর কোনও সমালোচনা হচ্ছে না। ইউক্রেনের হামলা নিয়ে এমন আলোচনা হচ্ছে, যেন তারা রাশিয়াকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনের যে ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে, সেই একটি ড্রোনের দাম ৪০ হাজার টাকা। ১১৭টি ড্রোনের দাম ৪৭ লক্ষ টাকা। মাত্র ৪৭ লক্ষ টাকা খরচ করে রাশিয়ার ৬০ কোটি টাকার যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দিল ইউক্রেন।
২০২২-এর ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন রাশিয়া দাবি করেছিল,ইউক্রেনের মতো ছোট দেশকে শেষ করতে ১ সপ্তাহ সময় লাগবে না। কিন্তু দেখতে দেখতে ৩ বছর হয়ে গেল। প্রচুর প্রাণ গেছে। প্রচুর টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবুও এখনও পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে দুই দেশ। কারণ পশ্চিমি দেশগুলির থেকে প্রচুর সাহায্য পেয়েছে ইউক্রেন। পশ্চিমী দেশগুলির থেকে প্রায় ৩২ লক্ষ কোটি টাকার অস্ত্র পেয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ার উপর একাধিক আর্থিক প্রতিবন্ধকতা লাগানো হয়েছে। সেজন্য কাঁচা তেলও সস্তায় বাজারে বিক্রি করত হয়েছে রাশিয়াকে। আমেরিকার পর রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী রয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রয়েছে ২০ নম্বরে।
ইউক্রেনের এই হামলায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্তিম বুদ্ধমত্তাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে মানুষের বুদ্ধিমত্তা। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাওয়ালা সমরাস্ত্র যখন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে হামলার সম্ভাবনাকে খুঁটিয়ে দেখছে, ঠিক তখনই মানুষের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে ট্রাকে করে ড্রোন পাঠিয়ে সংবেদনশীল জায়গায় হামলা চালিয়ে রাশিয়াকে ব্যাকফুটে ফেলল ইউক্রেনের মতো একটা ছোট দেশ।
বড় দেশগুলির হাতে রয়েছে বড় সেনাবাহিনী, বিশাল অর্থ ব্যবস্থা এবং দামি আধুনিক যুদ্ধবিমান। অন্যদিকে ছোট দেশগুলির হাতে না আছে বড় সেনাবাহিনী। না আছে বড় অর্থব্যবস্থা, না আছে দামি সমরাস্ত্র। এই পরিস্থিতিতে বড় দেশগুলির বিরুদ্ধে হামলার জন্য নানানরকমের রণনীতি নিয়ে থাকে ছোট দেশগুলি। ইউক্রেনও এমনটাই করে দেখাল।