১৩৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মাহেশের মন্দির এবং রথের অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না। পলাশির যুদ্ধের আগেই তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। তারপর আধুনিক এই রথযাত্রার ইতিহাসই রইল আজকের প্রতিবেদনে।
প্রবীর মুখার্জী, সাংবাদিক- মাহেশের আধুনিক এই মন্দিরটি কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার নয়নচাঁদ মল্লিক তৈরি করেছিলেন ১৭৫৫ সালে। প্রথম দিককার রথ সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। তবে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটীর এক ভক্ত একবার একটি রথ দান করেছিলেন। পরবর্তীকালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য বলরাম বসুর দাদা কৃষ্ণরাম বসু আরও একটি রথ দান করেছিলেন মহেশের মন্দির কর্তৃপক্ষকে। তাঁর ছেলে গুরুপ্রসাদ বসু ১৮৩৫ সালে সেই রথটি পুনর্নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু, সেই রথ কয়েক বছর পর পুড়ে গিয়েছিল। ১৮৫২ সালে কালাচাঁদ বসু আরও একটি রথ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু, সেই রথের মধ্যে একব্যক্তি আত্মঘাতী হওয়ায় সেই রথকে অশুভ বলে নষ্ট করে দেওয়া হয়. বিশ্বম্ভর বসু ১৮৫৭ সালে আরও একটি রথ তৈরি করে দেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই রথটিও পুড়ে যায়।
বর্তমানের এই রথটি ১৮৮৫ সালে মার্টিন বার্ন কোম্পানির তৈরি করে দেওয়া । কৃষ্ণরাম বসুর উদ্যোগে এই রথটি তৈরি করতে তখন খরচ হয়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। এই রথটির ৯টি শিখর বা চূড়া রয়েছে। রথটির কাঠামোটি সম্পূর্ণ স্টিলের তৈরি। রয়েছে ১২টি লোহার চাকা। প্রতিটি চাকার পরিধি ১২ ইঞ্চি। চারতলা এই রথটির উচ্চতা ৫০ ফুট। রথের ঘোড়াগুলি তামার তৈরি। ওজন ১২৫ টন।
পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের মতোই এখানেও স্নানযাত্রার দিন প্রচুর পরিমাণে গঙ্গার জল ও দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়। এরপর সন্ধ্যায় বিশেষ ধারণ করেন প্রভু জগন্নাথ দেব। তারপরেই মন্দিরের দরজা জনসাধারণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বাস অতিরিক্ত স্নানের জন্যই ভাইবোনেদের জ্বর আসে। তাই আরামবাগ-গোঘাট ঘাটাল থেকে একজন করে মোট তিনজন চিকিৎসককে দেবতার চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়। এই সময়, মূর্তিগুলির অঙ্গরাগ করা হয়। অর্থাৎ পুরীর জগন্নাথ দেবের নব কলেবরে মূর্তির পরিবর্তন করানো হলেও, হুগলির মাহেশে কিন্তু, প্রতিষ্ঠাতা কমলাকর পিপলাইয়েরর আমলে তৈরি সেই মূর্তিই পুজিত হয়ে আসছেন। স্নানযাত্রার পর দিন থেকে অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত এই সময়কালে জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রার মূর্তিতে বিশেষ রঙ দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। যে শিল্পী এই কাজ করেন, তিনিও বিশেষ নিয়ম মনে শুধুমাত্র তরলমিশ্রণ সেবন করেই মূর্তির অঙ্গরাগ বা শৃঙ্গার করে থাকেন। এই সময়ে তাঁর মাথার চুল ও নাক-মুখ ঢেকে রাখেন। শুধুমাত্র চোখদুটি খোলা রেখে কাজ করেন শিল্পী। এই পরিষেবার জন্য কোনও পারিশ্রমিক নেন না শিল্পী।
রথযাত্রার আগে জগন্নাথদেবকে রাজা হিসেবে শপথ গ্রহণ করানো হয়ে থাকে। রথের দিন একই সঙ্গে জগন্নাথ-বলভদ্র ও সুভদ্রাদেবীকে রথে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মাসীর বাড়ি। তার আগে রথের মাথায় বসানো হয় নীলকন্ঠ পাখি। সেই পাখিটি উড়ে গেলেই শোভাযাত্রা শুরু হয়। প্রায় একমাস ধরে চলে মহেশের এই মেলা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ,মা সারদা নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ মাহেশের এই রথযাত্রা দর্শন করেছিলেন। বাংলার সুপ্রাচীন রথযাত্রা বলতে এখনও মাহেশের নামই আসে সবার আগে।