Date : 2024-04-29

তারাদের গল্প : “অপুর সংসার” ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ হতে হতে সুযোগ না হওয়া-কতটা আফশোস হয়? – একান্ত আলাপচারিতায় লিলি চক্রবর্ত্তী

তারাদের গল্পে আজ যার সাথে গল্প করলাম, তাঁর সুদীর্ঘ বাষট্টি বছরের অভিনয় জীবনে একের পর এক প্রজন্মের যাতায়াত।তিনি বলিউড থেকে টলিউড-সর্বত্রই তাঁর সাবলীল অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন এমনভাবে, যে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় না করেও দর্শকদের হৃদয়ে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছেন। সুচিত্রা সেন থেকে মিমি চক্রবর্ত্তী, উত্তম কুমার থেকে যীশু সেনগুপ্ত অন্যদিকে সত্যজিত রায়,গুলজার থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ,কৌশিক গাঙ্গুলি- প্রত্যেকের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা-হ্যাঁ, এতটাই বিস্তীর্ন। তাঁর অভিনয়ের চারণক্ষেত্র। তিনি আর কেউ নন, আমাদের অতি পরিচিত অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্ত্তী। তাঁর সাথে গল্প করে আজ জেনে নিলাম তাঁর পছন্দ-অপছন্দ,ব্যক্তিগত জীবন,কর্মজীবন,স্মরণীয় মুহূর্ত,আফশোস ও নিজস্ব ভাবনার কথা। মজা করে খেললাম র‍্যাপিড ফায়ার গেম । জেনে নিলাম, এই প্রজন্ম ও আগামী প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য তাঁর কি টিপস্। দেখে নিন, কী জানালেন তিনি ?

(পছন্দ-অপছন্দ)

প্রশ্নঃ ছোটবেলায় মাঠে টাঙানো স্ক্রিনে সিনেমা দেখে শখ হতো, ওই স্ক্রিনে নিজের ছবি দেখার। এই পছন্দ,এই শখেই কি অভিনয়কে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়া ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ না,ঠিক সেটা নয়। আমি তো মধ্যপ্রদেশে থাকতাম। ছোটবেলায় মা আমাদের দিয়ে নাটক করাতেন।শুধু মা নয়, অন্যরাও আমাকে ছোটদের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ডাকতেন । আমার যেহেতু আগ্রহ বেশি ছিল,তাই যেখানেই বাঙালিদের সংস্কৃতিচর্চা হত, সেখানেই নাটক করতাম । এইভাবেই অভিনয়ের বীজ বপন হয়েছিল আমার মনে। তবে মাঠে টাঙানো স্ক্রিনে সিনেমা দেখে আমার মনে হত, আমাকেও যদি এভাবে দেখা যেত ! তখন তো ভাবতেই পারতাম না,কোথায় স্টুডিও, কোথায় ডিরেক্টর-কিছুই জানতাম না।

প্রশ্নঃ নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল-এগুলির মধ্যে কোনটিতে কাজ করা আপনার বেশি পছন্দের ? কেন ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আমার ভাল লাগত নাটক করতেই । অনেক নাটক করেছি । ‘বিলকিস বেগম’ ৫ বছর চলেছিল। সৌমিত্রদার সঙ্গে ‘নামজীবন’ ৩ বছর চলেছিল। লাস্ট নাটক করেছিলাম বিশ্বরূপাতে।

প্রশ্নঃ সিরিয়ালে অভিনয় করা পছন্দ নয় কেন ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ পছন্দ নয়, কারণ সব একই ধরণের গল্প । আর এখন সাহিত্যনির্ভর গল্পেও সিরিয়াল হয় না।

(ব্যক্তিগত জীবন)

প্রশ্নঃ সংসারের হাল ধরার তাগিদেই কি প্রথম অভিনয়ের জগতে আসা ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ পার্টিশনের একবছর আগে এসেছি কলকাতায়। আমরা ঢাকা থেকে চলে এসেছিলাম। বাবার যা কিছু সম্পত্তি ছিল ঢাকাতেই পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই,আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না। তখন আমার মেজদি ছোটখাটো ক্লাবে নাটক করত। একদিন রিহার্সালে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেইসময় নাটকের ডিরেক্টর আমাকে দেখে, একটা চরিত্রে অভিনয় করে দিতে বলেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম কিন্তু আমার মেজদি আমাকে খুব বকেছিল,বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া আমি রাজি হয়ে যাওয়ায়। তখন নিউ অ্যাম্পায়ারে হয়েছিল মর্নিং শো। সেই নাটক দেখে অফিসক্লাব থেকে অভিনয়ের জন্য আমাকে সুযোগ  দেওয়া হয়। তখন আমি মাধবীদি,গীতাদি সকলের সাথেই নাটক করি। এরপর কুনাল মুখার্জিই ওনার দাদার ছবি “ভানু পেল লটারী”তে আমাকে অভিনয়ের সুযোগ দেন। প্রথম দিন আমি স্টুডিওতে গিয়ে জহর রায় আর কমল মিত্রের সঙ্গে অভিনয় করি। ছোট টাইপিস্টের রোল। তখন বাবার হাতে ৫০ টাকা দিয়েছিল। বাবা ভাবতেই পারেননি। এইভাবেই ধীরে ধীরে অভিনয়ের জগতের দরজা খুলে যেতে শুরু করে আর সংসারের হাল ধরতেও আমি সাহায্য করতে পারি।

প্রশ্নঃ মধ্যপ্রদেশে বড় হওয়ায় হিন্দি ভাষায় আপনি সাবলীল ছিলেন। এই কারণেই কি মুম্বইতে কাজের ক্ষেত্রে দরজা খুলে যায় ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ জানিনা, তবে সুলোচনা দেবী বলে একজন বাঙালি আর্টিস্ট এসেছিলেন,”জননী” বলে একটি ছবি করতে। ওনার পুত্রবধূর চরিত্রে আমি অভিনয় করি। ওনার স্বামী (নাম-ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়) পরে কলকাতায় আমাদের বাড়ি আসেন। তিনি আমাকে একটা হিন্দি মাইথোলজিক্যাল ছবি “সম্পূর্ণ বিষ্ণুপুরাণ” ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। এই প্রথম হিন্দি ছবিতে কাজ। তারপর একের পর এক সুযোগ আসতে থাকে। সেটা হিন্দিতে আমি সাবলীল বলে নাকি অভিনয়ে,তা ঠিক জানিনা।

প্রশ্নঃ পার্টিশনের একবছর আগে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে আসা। ফের মধ্যপ্রদেশ চলে যাওয়া-স্ট্রাগল আর স্ট্রাগল। এইটাই কি সফল অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্ত্তী হয়ে ওঠার চাবিকাঠি ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আসলে আমার বাবা মধ্যপ্রদেশ চলে আসার পর অনেক স্ট্রাগল করেছেন। তখন বাবা-মায়ের ছত্রছায়ায় অতটা বুঝতে পারিনি জীবন সংগ্রামটা। তবে পরবর্তীকালে একে একে কাজের সুযোগ এসেছে। আর এক-একটা দরজা খুলে গিয়েছে। কাজের জন্য আমাকে কারও কাছে যেতে হয়নি। এইভাবেই লিলি চক্রবর্ত্তী হয়ে ওঠা। 

প্রশ্নঃ ছোটবেলায় মা দীপ্তি চক্রবর্ত্তীর হাত ধরে নাটকের মঞ্চে প্রবেশ। তখন থেকেই কি এতটাই সাবলীল লিলি চক্রবর্ত্তী ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ হ্যাঁ, তখন থেকেই আমি খুবই সাবলীল । আমাকে যেমন অভিনয় করতে বলা হত, বিনা জড়তায় করে দিতে পারতাম খুব ছোট থেকেই।

(কর্মজীবন)

প্রশ্নঃ বলিউড থেকে টলিউড- দীর্ঘসময় ধরে সর্বত্র আপনার বিচরণ। কী কী তফাৎ চোখে পড়ে ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ বলিউডে এখন যেসব ছবি দেখি, অনেক উন্নত হয়েছে আগের থেকে । প্রযুক্তি তো বটেই এমনকি অভিনয়ও অনেক উন্নত হয়েছে । মানিকদার সঙ্গে যখন কাজ করেছি তখন মনিটর ছিল না। মনিটর ছাড়াই শুধু চোখে দেখেই ওইসব ছবি করেছেন ওনারা। এখন তো কতও উন্নত। এমনকি গল্প বা কনটেন্টও অনেক উন্নত হয়েছে। আমাদের সময়টাও ভাল ছিল। তবে এখন আরও অনেক উন্নত।

প্রশ্নঃ বলিউড ও টলিউডে -ওয়ার্ক কালচারে কী পার্থক্য রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ বলিউড অনেক বেশি প্রফেশনাল।

প্রশ্নঃ অসিত সেনের রেকমেন্ডেশনেই কি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ মানিক দা যখন “অপুর সংসার” করছেন,তখন শর্মিলার সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু শর্মিলার স্কুল নিয়ে কিছু একটা সমস্যা হচ্ছিল। তাই ব্যাক-আপ আর্টিস্ট হিসাবে অসিত সেন আমার নাম রেকমেন্ড করেছিলেন মানিকদার কাছে।  তার আগে “দীপ জ্বেলে যাই” ছবিতে আমি একটা ছোট রোলে অভিনয় করি। সেই অভিনয় দেখেই অসিত সেন আমার নাম বলেন সত্যজিৎ রায়ের কাছে।

প্রশ্নঃ “আলাপ” ছবির শ্যুটিংয়ের মাঝেই “জনঅরণ্যে”এর জন্য ১১ দিন শ্যুটিং করতে চলে আসা কলকাতায়। কতটা কো-অপারেশন ছিল ঋষিকেশ মুখার্জির ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আলাপ” এর শ্যুটিং প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। একটা সিন বোধহয় বাকি ছিল। ঋষিদা যেই শুনলেন সত্যজিৎ রায় চিঠি পাঠিয়েছেন,তখন উনি বললেন “তুমি যাও যাও….ওই ছবিটাই কর আগে। দরকার হলে আমি ঠিক ডেকে নেব, ঠিকসময়ে। “এটা তখনকার দিন বলেই সম্ভব হয়েছিল।

প্রশ্নঃ ঐশ্বর্য রাই আপনাকে “মা” বলে ডাকত। কীভাবে গড়ে উঠেছিল এই সম্পর্ক?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ “চোখের বালি”তে আমি রাজলক্ষ্মীর ভূমিকায় বুম্বার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি। ঋতুপর্ণ ঐশ্বর্যকে বলে দিয়েছিল যে আমি আগে বম্বেতে কাজ করেছি, অমিতাভের সঙ্গে। জয়া বচ্চনের সঙ্গেও কাজ করেছি বাংলা ছবিতে। সেইজন্য ঐশ্বর্য জানত যে,আমি অনেক পুরোনো আর্টিস্ট। তাই শ্যুটিংয়ের প্রথম দিনই আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে, “ম্যায় আপকো মা বোলুঙ্গি,আপকো বুড়া তো নেহী লগেগা ? “আমি বলেছিলাম, “বিলকুল নেহী“। এইভাবেই ওর সাথে পরিচয়। ও সেটে বসে থাকত আমার অভিনয় দেখার জন্যে।

প্রশ্নঃ “দেয়া-নেয়া” করার সময়ে কীভাবে ন্যাচারাল অ্যাক্টিং করতে হয়-উত্তমকুমার আপনাকে শিখিয়েছিলেন। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আমি তখন ৪-৫ বছর হল ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছি।  একেবারে নতুন। উনি কিন্তু এমন ভাব দেখাতেন যেন কতদিনের চেনা। কখনই বুঝতেই দিতেন না যে, আমি নতুন। যাই হোক,আমরা বসেছিলাম শ্যুটিংয়ের মাঝে,তখন উনি হঠাৎ একটা ডায়লগ বললেন। বুড়োদাও উত্তর দিল। আমিও উত্তর দিলাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম,আমরা কি রিহার্সাল করছি ? তখন উনি বললেন, দেখেছ ? গল্প করতে করতে এই যে কথাগুলো বেরিয়ে এল,কতো ন্যাচারাল!এইভাবেই ন্যাচারাল অ্যাক্টিংটা প্র্যাকটিস করতে হয়।

(স্মরণীয় মুহূর্ত)

প্রশ্নঃ “জন অরণ্যে” ছবিতে অভিনয়ের জন্য সত্যজিত রায় যখন চিঠি পাঠান-কতটা স্মরণীয় সেই মুহূর্ত ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আমার হাত-পা কাঁপছিল। আমার বর জিজ্ঞাসা করছিল, “কার চিঠি,কার চিঠি ?”আমি উত্তর দিতে পারছিলাম না।  শুধু চিঠিটা এগিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর চিঠিটায় শুধু নীচে সত্যজিত রায় লেখা। কোনও ঠিকানা নেই। আমি জানতাম, ওই নামে চিঠি পাঠালে উনি ঠিকই পেয়ে যাবেন। তবু যদি না পান! আমি আবার বিমলবাবুর স্ত্রী মনোবীণা রায়কে ফোন করলাম। তারপর সেইখান থেকে ওনার ঠিকানা জোগাড় করলাম। তারপর চিঠির উত্তর পাঠালাম।

প্রশ্নঃ টাকা-পয়সার কথা না বলেই পুরো “অচানক” ছবিটি করে ফেললেন। তারপর প্রোডিউসর ডেকে যখন চেক দিলেন- মনে আছে সেই কথা ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আমি তো ভাবতেই পারিনি। আমি কাজ করে গেছি কিন্তু কোনও পয়সাকড়ি চাইনি। তাই ওই একই প্রোডাকশনে ৩-৪ টে ছবি করেছি। প্রোডিউসর এন.সি.সিপ্পি ডেকে আমাকে বলেছিলেন, “তু মেরী বড়ি বেটি হ্যায়“। এই বলে তিনি আমাকে চেক হাতে দিয়েছিলেন। খুব সুন্দর সম্পর্ক ছিল।

প্রশ্নঃ অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে প্রথম অভিনয় “চুপকে চুপকে” ছবিতে। তারপরে “আলাপ”ছবির শ্যুটিং চলাকলীন উনি নিজে ডেকে আপনার সঙ্গে কথা বলেন। সেদিনের গল্পটা যদি একটু বলেন। 

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ “আলাপ”ছবির যখন শ্যুটিং চলছে, তখন ঋষি দা সেটের বাইরে একটা চৌকিতে বসে দাবা খেলছিলেন। আর অমিতাভ সেখানে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আমি মেক-আপ করে ঋষিদাকে দেখাতে গিয়েছি। ঋষিদাকে দেখিয়ে ফিরে আসছি,তখন অমিতাভ বলেছিল,” কেয়া লিলিজি, একসাথ কাম কিয়া,হ্যালো ভি নেহী বোলা,হায় ভি নেহী বোলা,ওয়াপস চলি যা রহী হ্যায়?” আমি একটু লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম।

প্রশ্নঃ সত্যজিৎ রায়-বিজয়া রায়ের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আমি তো ভাবতেই পারিনি। ওনাদের সঙ্গে একসাথে বসে খাওয়া-দাওয়া করা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এমনিতেও ওনাদের বাড়িতে গেলে,বৌদি বাড়িতে না থাকলেও মানিক দা যে আতিথেয়তা করতেন, আমি ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতাম।

(আফশোস)

প্রশ্নঃ “অপুর সংসার” ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ হতে হতে সুযোগ না হওয়া-কতটা আফশোস হয় ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আফশোস হয় তো বটেই। শর্মিলার সাথে আগে কথা হয়ে গিয়েছিল। বললাম তো ওর স্কুলের কি একটা সমস্যার জন্য আমাকে ব্যাক-আপ আর্টিস্ট হিসাবে উনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি যেদিন ওনার বাড়িতে যাই, নানারকম হেয়ার স্টাইল করে বৌদি আমাকে সাজিয়ে সাজিয়ে মানিক দাকে দেখাচ্ছিলেন। সত্যজিৎ রায় আমাকে বলেছিলেন, তোমায় আমার খুব পছন্দ হয়েছে, কিন্তু আমি তো একজনের সাথে আগে কথা বলে রেখেছি,যদি সেখানে না হয়,তাহলে তুমিই করবে চরিত্রটা। তারপর তো শর্মিলা ঠাকুর করল ছবিটা। আমি বুঝলাম যে কি হারিয়েছি !

প্রশ্নঃ পরিস্থিতির চাপে পড়াশুনা করার সেভাবে সুযোগ হয়নি-আক্ষেপ হয় ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আক্ষেপ হয় বইকি ! তবে আমার স্বামী আমাকে খুবই সাপোর্ট করতেন। একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আমাকে পড়াতে আসতেন।

প্রশ্নঃ এতো সাবলীল অভিনয় সত্ত্বেও নায়িকা হওয়ার সুযোগ হয়নি। আফশোস হয় ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আসলে চরিত্রাভিনেত্রী হলে, অনেক ধরণের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ হয়। আর নায়িকা হিসাবে সেরকম সেরকম ছবি হলে, যেমন “কাঁচ কাটা হীরে” করেছিলাম-একটু অন্য ধরণের ছবি,তাতে অভিনয় করতে ভাল লাগত। তবে আমার কাছে যেরকম যেরকম সুযোগ এসেছে, আমি করেছি। পরিস্থিতির চাপে, অনেকের চাপে তখন অনেক ছবিতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় হাতছাড়া হয়েছে। তবে আমার যতটুকু পাওনা, আমি তো ততটুকুই পাব-তাই না ?

প্রশ্নঃ প্রোডিউসররা টাকা দিয়ে দেওয়ার পরও কাজ হাতছাড়া হয়ে গেছে বহুবার। সেইসময়গুলিতে কতখানি আক্ষেপ জন্মেছে ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আক্ষেপ ঠিক নয়, ওই যে বললাম, আমার যতটুকু পাওনা আমি ঠিক ততটুকুই পাব। এখন আমার ৮০ বছর বয়স। ৬২ বছর ধরে অভিনয় করছি। এখনও সারাক্ষণই কাজ আসে। সমস্ত ভাল ডিরেক্টরের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি। 

(নিজস্ব ভাবনা)

প্রশ্নঃ প্রশিক্ষণ,চেতনা,প্রতিভা কোনক্রমে সাজাবেন ভাল অভিনয় করার জন্য ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ দেখ, প্রশিক্ষণে কিছু হয় না। একটু প্রতিভা থাকা দরকার । আর চেতনা সবচেয়ে বেশি দরকার।

প্রশ্নঃ প্রযুক্তির মান বেড়েছে,অভিনয়ের মান বা পরিশ্রম কি কমেছে ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ সেইসময় আমাদের বেশি পরিশ্রম হত না। আমরা সকাল ৯ টায় স্টুডিওতে যেতাম। আর বিকেল ৬ টা হলেই প্যাক-আপ হয়ে যেত। নিয়মানুবর্তিতা ছিল কিন্তু এখন অনেক বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়। তাই পরিশ্রম কমেছে-একথা বলতে পারব না।

প্রশ্নঃ দীর্ঘকাল অভিনয়ের জগতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে কি কি পরিবর্তন এনেছেন নিজের মধ্যে ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ যে যে ছবি করেছি, প্রত্যেকটা স্ক্রিপ্ট এখনও রয়েছে আমার কাছে। আমি স্ক্রিপ্টটা খুব ভালভাবে পড়ে চরিত্রটা নিজের মাথার মধ্যে বসিয়ে নিই। তারপর যখন অ্যাক্টিং করি ডিরেক্টরদের খুব পছন্দ হয়। এইভাবেই কাজ করে এসেছি আগাগোড়া।

প্রশ্নঃ সব ভাল পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। এটা কি অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্ত্তীর ক্রেডিট না ভাগ্য?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ ভাগ্য, নিশ্চয়ই ভাগ্য। আমি নিজের ক্রেডিট কখনই বলতে চাই না।

প্রশ্নঃ করোনাকালে শিল্পীদের যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে,সেবিষয়ে কি বলবেন?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ আমাদের সময়ে শিল্পীরা সুরক্ষিত ছিল না। তবে এখন আগের থেকে বেশি সুরক্ষিত। 

(আগামীর পরিকল্পনা)

প্রশ্নঃ পরবর্তী কাজের বিষয়ে কি খুব সিলেকটিভ হয়ে যাবেন ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ হ্যাঁ। অনেক কাজ করেছি। এখন একটু বেছেই কাজ করি। গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্সে কাজের ক্ষেত্রে খুব পরিচিত হলেই করি।

(লিলি চক্রবর্ত্তীর টিপস্)

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ মন দিয়ে অভিনয় করতে হবে। অভিনয় ছাড়া অন্য কিছু মাথায় রাখা চলবে না। নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখতে হবে।  ডিগনিটি রাখতে হবে। আর একটু বিনয়ী হতে হবে। টেকনিসিয়ানদের সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে। লক্ষ্যে স্থির হতে হবে।

(র‍্যাপিড-ফায়ার)

প্রশ্নঃ আজও বাংলাদেশের ঢাকা শহর টানে আপনাকে?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ হ্যাঁ

প্রশ্নঃ আপনার স্বামীর সহযোগিতা ছাড়া কি এই জার্নি সম্ভব ছিল?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ  না

প্রশ্নঃ দীর্ঘসময় কাজ করার জন্য মেন্টাল ফিটনেস্ কি বডি ফিটনেসের চেয়েও বেশি জরুরী ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ  হ্যাঁ তবে বডি ফিটনেসও জরুরি।

প্রশ্নঃ পুরোনো সময়টা আবার ফিরে পেতে চান ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ  হ্যাঁ তবে চাইলেও ফেরত পাওয়া যাবে না।

প্রশ্নঃ পুরোনো বাংলা কর্মাশিয়াল ছবি কি আপনার অনেক মনের কাছাকাছি ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ  না, প্যারালাল মুভি আমার বরাবর পছন্দের।

প্রশ্নঃ সিরিয়ালের চেয়ে কার্টুন দেখতে কি বেশি ভাল লাগে ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ  হ্যাঁ

প্রশ্নঃ ভাগ্যে বিশ্বাস করেন ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ  হ্যাঁ

প্রশ্নঃ বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত, তাও কি মানুষের সাথে মানুষের যোগ হারাচ্ছে ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ হ্যাঁ, যোগ কমেছে

প্রশ্নঃ শিল্পের ক্ষেত্রে গুণমানের চেয়ে কি ব্যবসা বেশি জরুরী ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ  দুটোই জরুরি (হ্যাঁ বা না-তে উত্তর দিতে পারলাম না)

প্রশ্নঃ কোনওদিন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ এসেছে ?

লিলি চক্রবর্ত্তীঃ  না, আর চাইও না