মাম্পী রায়, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ বাংলাকে বাঁচিয়ে ল্যান্ডফল করল ওড়িশাতে। ভিতরকণিকা ও ধামরার মাঝে ল্যান্ডফল করে এই ঘূর্ণিঝড় ডানা। ল্যান্ডফলের সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল প্রায় ১২০ প্রতি কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত বঙ্গোপসাগরের ত্রিভুজ আকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হয়ে আসছে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা। ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড নামে একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের ৩৫টি সবচেয়ে বিপজ্জনক মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী, ২৬টি ঘূর্ণিঝড়ই তৈরি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এই ঘূর্ণিঝড়েই লন্ডভন্ড হয়েছে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা সহ উপকূলবর্তী রাজ্যগুলি।
এবারেও ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে মানে মানে বাঁচল বাংলা। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ল্যান্ডফল না করলেও, বৃষ্টির জেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলার একাধিক জেলা। পুজোর আগেই ব্যাপক বন্যাপরিস্থিতি কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলা। পুজো মিটতেই ফের দুর্যোগ। শহর কলকাতার একাধিক জায়গায় হাঁটুজল জমে যায়। জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ৩জনের মৃত্যু হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া সহ একাধিক জেলায় মাঠেই শুয়ে পড়েছে ধান সহ একাধিক শস্য। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। যদিও কৃষকদের কথা মাথায় রেখে শস্যবিমার ফর্ম জমা করার সময়সীমা ৩১ নভেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অন্যদিকে, বিষ্ময়করকাণ্ড হল এই যে, ঘূর্ণিঝড় ডানা ওড়িশায় ল্যান্ডফল করলেও সেখানে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এর পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ভিতরকণিকার ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। ম্যানগ্রোভের দক্ষিণ পশ্চিমেই প্রধানত ঝোড়ো হাওয়া ধাক্কা মারে। সুন্দরবনের মতো ভিতরকণিকাতেও রয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ধামরার বিপরীতে ৯টি দ্বীপ ম্যানগ্রোভ অরণ্যে ভরা। সেই ম্যানগ্রোভ অরণ্যই বাঁচিয়ে দিয়েছে উপকূলের বাসিন্দাদের। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওড়িশার মন্ত্রী সূর্যবংশী সূরজ। তিনি জানিয়েছেন, ম্যানগ্রোভের জেরে জনবসতিতে কোনও প্রভাব পড়েনি। ঝড়ের জেরে বিদ্যুৎ পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়। বৃষ্টি থেমে গেলে ফের চালু করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ পরিষেবা। মন্ত্রী জানান , ভিতরকণিকা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে যেখানে ডানা ল্যান্ডফল হয়েছে সেখানে মানুষের বসবাস নেই। সেখানে রয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। সেই জঙ্গলই হাওয়ার গতি কম করে দিয়েছে। ওড়িশা প্রশাসনের উদ্যোগে ১ লক্ষের বেশি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী সূর্যবংশী সূরজ।
ভিতরকণিকা লাগোয়া বাসিন্দাদের একাংশ বলছেন, বৃহস্পতিবার মাঝরাতের আগে সবকিছু যেন থমকে গিয়েছিল। বৃষ্টি, হাওয়া কিচ্ছু ছিল না। তারপরই হানা দেয় ডানা। ব্যাপক শব্দে হাওয়া বইতে থাকে। রাত দেড়টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দাপট দেখিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ডানা। সাধারণত ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার ছিল এই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ। তবে বিক্ষিপ্তভাবে ১২০ কিলোমিটার ছিল ডানার গতিবেগ। কিন্তু এই ডানা বড় আকার ধারণ করতে পারেনি, তার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ম্যানগ্রোভ অভয়ারন্যের। ম্যানগ্রোভের গুরুত্ব নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের সচেতন করতে ওড়িশা ও কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে বলে মনে করছেন উপকূলবর্তী বাসিন্দাদের একাংশ।
একদিকে ঘূর্ণিঝড় ডানার প্রভাব থেকে ওড়িশাকে বাঁচাতে ত্রাতার ভূমিকা পালন করল ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। তখন বারবার দুর্যোগের জেরে কেন ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে সুন্দরবনকে ? কারণ বেআইনিভাবে সুন্দরবনে বিঘার পর বিঘা ম্যানগ্রোভ কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। সেখানে তৈরি হয়েছে মাছ চাষের ভেড়ি। একাধিকবার এমন অভিযোগ উঠে এসেছে। তা ছাড়া, গাছ কেটে কাঠ চুরিও করে অনেকে। পুলিশ-প্রশাসনের সে দিকে নজর নেই বলেও অভিযোগ উঠছে। সুন্দরবনের মাতলা, বিদ্যা, গোমর, হোগল নদীর পাড়ে রাতের অন্ধকারে ম্যানগ্রোভ কেটে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে একাধিকবার। মাতলা নদীর চরের ম্যানগ্রোভ গাছ কেটে জেসিবি মেশিন দিয়ে মাটি কেটে তৈরি করা হচ্ছে বেআইনি মেছোভেড়ি। স্থানীয় নেতাদের মদতেই নাকি এধরণের কাজ চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এবিষয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জানিয়েও কোনও কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাসিন্দাদের একাংশ। পরিবেশবিদেরা বলছেন, সুন্দরবনে এ ভাবে গাছ কাটা চলতে থাকলে শুধু যে অরণ্য ধ্বংস হবে, তা নয়। বিপন্ন হবে বিস্তীর্ণ এলাকার পরিবেশ। সুন্দরবনের ৩২০০ কিলোমিটার নদীবাঁধের মধ্যে আয়লার দাপটে ৭৭৮ কিলোমিটার অংশ ভেঙে গিয়েছিল। তার উপরে নদী তীরবর্তী ম্যানগ্রোভের ধ্বংস হওয়ায় বাড়ছে ভূমিক্ষয়ের প্রবণতাও। জমির পর জমি তলিয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে। জমি হারিয়ে দিন দিন নিঃস্ব হচ্ছেন নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেভাবে ম্যানগ্রোভের ধ্বংসলীলায় মেতেছে, তাতে সুন্দরবনকে কীভাবে বাঁচানো যাবে, তা নিয়েই চিন্তায় পরিবেশবিদদের একাংশ।