জরাজীর্ণ মস্ত বড় এক প্রাসাদ। একসময় অট্টালিকাটির রং ছিল গাঢ় লাল। যা আজ রোদ ঝড় বৃষ্টি ও অযত্নে বোঝা কঠিন। বাড়িটিকে আষ্টপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে বট অশ্বথের ঝুরি। বাড়িটি জুড়ে বর্তমানে শুধুই নীরবতা ও গা ঝমঝমে পরিবেশ।
নাজিয়া রহমান, সাংবাদিক-১২নম্বর রাজা সুবোধ মল্লিক স্ট্রিট। মহানগরের বুকে কলকাতা পুরসভার কাছেই রাজা সুবোধ মল্লিকের বিশাল প্রাসাদ। বাড়িটির দিকে এক ঝলক তাকালে মনে হবে এই বুঝি ভেঙে পড়লো বোধ হয় এই অট্টালিকা । বাড়িটি জুড়ে দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দেওয়ালে ধরেছে নোনা। দাঁত নখ বের করা বট অশ্বত্থের ঝুরি যেন হিংস্রভাবে বেরিয়ে আছে চারপাশে। মরচে পড়া গ্রিল এমনভাবে ঝুলে আছে দেখলেই মনে হবে এই বুঝি ভেঙ্গে পড়লো। অনেকদিন আগেই পুরসভার তরফ থেকে ‘ বিপজ্জনক বাড়ি’ বলে বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝে মধ্যেই বাড়ির ভেতরে দেওয়াল, ছাদের অংশ ভেঙে পড়ে। তবুও বিপজ্জনক এই বাড়িটিই বেশ কয়েকজনের আশ্রয় স্থল। রাত হলে এই বাড়িটির দেওয়ালের পাশেই শুয়ে থাকেন বেশ কয়েকজন মানুষ। বাড়িটির এক দেওয়াল ঘেষে রাস্তায় প্রায় তিরিশ বছর ধরে বিহারের বাসিন্দা মন্টু রজক জামাকাপড় ইস্ত্রির কাজ করেন। রাত হলে এই বাড়ির গা ঘেষেই ঘুমিয়ে পড়েন। ভূতের ভয় না পেলেও বাড়িটি ভেঙে পড়ার ভয় প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াই। রীতিমতো প্রাণ হাতে নিয়ে জীবন কাটান। তার মতই এই বাড়িটির গা ঘেষে রাত কাটান ট্যাক্সি ড্রাইভার চন্দেশ্বের রায়। বছর ৬৪ র চন্দেশ্বর রায়ের বক্তব্য, কখন বাড়িটি ভেঙে পড়বে তার আতঙ্কে দিন কাটে।
এবার জেনে নেওয়া যাক কে এই রাজা সুবোধ মল্লিক? সুবোধ চন্দ্র মল্লিক বা রাজা সুবোধ মল্লিক কলকাতার পটল ডাঙ্গার বাসিন্দা দেশের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স বিদ্যালয় থেকে স্কুলস্তরের পড়াশোনা শেষ করে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। এরপর ১৯০০ সালে এফ এ ডিগ্রি লাভ করার পর ইংল্যান্ডে আইন পড়ার জন্য ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন সুবোধ মল্লিক। তবে একবছরের মধ্যে পারিবারিক কারণে তিনি ইংল্যান্ড থেকে কলকাতা ফিরে আসেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের বাড়িটি থেকেই স্বদেশী আন্দোলনের কার্যকলাপ চলতে থাকে বলে জানা যায়। ১৯০৬ সালে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১ লক্ষ টাকা দান করেন। সুবোধ মল্লিকের কর্মকাণ্ডের জন্য দেশবাসী উল্লসিত হয়ে তাঁকে “রাজা” উপাধি দেন। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে অবস্থিত এই বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজি দাঁড়িয়ে আছে।
বর্তমানে এই বাড়িটি তার জৌলুস হারিয়েছে। সন্ধ্যা নামলেই বাড়িটি আলোআঁধারিতে এক ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। বাড়িটিকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখা বট ও অশ্বত্থের গাছগুলি দেখলে মনে হবে একেঅপরকে যেন ছুঁতে চাইছে।সন্ধেবেলায় এই বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেই বা তার দোতলা তিনতলার ভাঙা-কপাট অন্ধকার জানলাগুলোর দিকে তাকালেই গা ছমছম করে ওঠবে। আর সেজন্যই বোধহয় রাজা সুবোধ মল্লিকের বাড়ি আজ লোকের মুখে কলকাতার ‘হনটেড হাউজ’-এর তালিকায়। এই বাড়িটি লাগোয়া ফুটপাতে বেশ কয়েকজন পরিবার পরিবার- সন্তান নিয়ে বসবাস করত। কিন্তু বিপজ্জনক বাড়ি হওয়ায় তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে কাউন্সিলর। সেই ফুটপথের বাসিন্দা সুনিতা সানাই, শিবু সাহাদের বক্তব্য এই বাড়িতে নিশুতি রাতে কারা যেন ঘুরে বেড়াই। পায়ের নুপুরের শব্দও নাকি তারা শুনেছে। এই গল্পকথার বাস্তবে কোনও তথ্য প্রমান অবশ্য নেই।
বিজ্ঞান বলে ভূত বলে কিছু নেই, এটা মানুষের একটা কল্পনা। তাই এই প্রাসাদ নিয়ে গল্পকথার কোনও বাস্তবতাও হয়তো নেই। তবে এই বাড়ি বহু ইতিহাসের সাক্ষি আজ বহন করে নিয়ে চলেছে। ১৮৮৩ সালে বর্তমানের এই জীর্ণ বাড়িতে এক সময় রবীন্দ্রনাথের যাতায়াত ছিল। ১৯০৭ সাল পর্যন্ত রাজা সুবোধ মল্লিকের এই বাড়িতে অতিথি হিসেবে ছিলেন ঋষি অরবিন্দ। বর্তমানে এই বাড়িটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মী এখনও এই বাড়িতে বসবাস করেন। তবে তাঁরা কেউই বাড়িটি সম্পর্কে কোনও কিছু বলতে নারাজ।কলকাতা পুরসভার তরফ থেকে এই ধরণের বাড়িগুলোকে কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়েও ভাবনা চিন্তা চলছে। তবে এই বাড়িটি সংরক্ষণ করা না হলে এই বাড়ির সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে অনেক ইতিহাস।