মাম্পি রায়, সাংবাদিক- ইরানে ঢুকে পারমাণবিক কেন্দ্রগুলি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। যার পোষাকি নাম অপারেশন রাইসিং লায়ন। প্রায় ৩৩০টি মিসাইল ছুঁড়েছে ইজরায়েল। এরপর ইরান বদলা নিলে ব্যাপক অস্থিরতা বাড়বে মধ্যপ্রাচ্যে। এর ফলে বাড়তে পারে পেট্রোল ডিজেলের দাম। ফলে সরাসরি সাধারণ মানুষের পকেটেও পড়বে তার প্রভাব। তাই ইরান-ইজরায়েলের যুদ্ধ এখন সারা বিশ্বের আলোচ্য বিষয়। কীভাবে হামলা করা হয়েছে, তার যথাযথ ভিডিও তৈরি করে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে ইসরায়েল। ইরানও ইসরায়েলের থেকে এর প্রমাণ চাইতে পারবে না। কারণ ইসরায়েল নিজেই সেই ভিডিও সকলের সামনে তুলে ধরেছে। কীভাবে যুদ্ধবিমানগুলি হামলার জন্য রওনা দিল, কীভাবে হামলা চালাল, পুরোটাই প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। যুদ্ধের একটা নতুন রূপ তুলে ধরেছে তারা।
ইসরায়েলের অন্যতম শক্তি হল, এদের যুদ্ধ পরিকল্পনা কখনও ফাঁস হয় না। ১২ জুন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু ইহুদিদের সবচেয়ে জাগ্রত ধার্মিক স্থান ওয়েস্টার্ন ওয়ালে গিয়েছিলেন। সেখানে বাইবেলের মধ্যে কাগজে একটি প্রার্থনা লিখে আসেন। যার অর্থ, একটি দেশ যে সিংহের মতো উঠে আসে। যা বুঝতে পারেনি ইরান। বিশ্বের কেউ সেই সাংকেতিক কথা বোঝেননি। তারপর ১৩ জুন ইজরায়েল সবচেয়ে বড় হামলা চালায় ইরানে। যার নাম – অপারেশন রাইসিং লায়ন। অন্তত ৩৩০ টি মিসাইল দিয়ে হামলা চালানো হয়। ইরানের শতাধিক জায়গাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল। এর মধ্যে ৬টি জায়গা ছিল এমন, যেখানে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছিল। সোশ্যাল মিডিয়াতে এই হামলাকে অষ্টম আশ্চর্য বলেও বর্ণনা করা হচ্ছে। কারণ এটি এমন একটা অপারেশন ছিল, যেখানে ইরানকে এক মুহূর্ত ভাবনাচিন্তার সময় দেয়নি। এবার প্রশ্ন কীভাবে এই হামলা চালাল ইসরায়েল ?
ইউক্রেন যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর আড়ালে রাশিয়াতে ড্রোন পাঠিয়ে হামলা চালিয়েছিল ,ঠিক সেইভাবেই সড়ক ও সমুদ্রপথে চোরাপথে বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোনগুলি ইরানের ভিতরে পাঠায় ইসরায়েল। যেখানে হামলার পরিকল্পনা ছিল, সেখানে ড্রোন বেস বানানো হয়। ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থাও কোনওভাবে এই খবর ফাঁস হতে দেয়নি। এরপর সাইবার অ্যাটাকের মধ্যমে ইরানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকেই বিকল করে দেওয়া হয়। এর ফলে হামলা হতে পারে, এমন কোনও অ্যালার্ট পায়নি ইরান। যে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের এই হামলা রুখে দেওয়ার কথা ছিল, তাদেরকেই নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। যে ড্রোনগুলি আগে থেকেই ইরানে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যমেই তাদের পুরো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নষ্ট করে ফেলা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। যুদ্ধের ভাষায় একে বলে শত্রুর হাত কেটে দেওয়া। হাত কেটে দিলে হামলা ঠেকাতে পারবে না শত্রু, সেজন্যই এই পদক্ষেপ করা হয়। যখন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বিকল হয়ে গিয়েছে, ব়্যাডার কাজ করছে না। ঠিক তখনই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রায় ২০০টি যুদ্ধ বিমানের সাহায্যে আলাদা আলাদা জায়গায় হামলা চালানো হয়। এয়ার টু সারফেস এবং সারফেস টু সারফেস মিসাইলের সাহায্যে আক্রমণ শানানো হয়। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ বলছেন পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ বিমান ব্যবহার করা হয়েছে এই হামলায়। এর মধ্যে আমেরিকার এফ-৩৫ বিমানও থাকতে পারে। ইরানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নষ্ট করে ফেলায় হামলা চালিয়ে ফিরে আসাটা বেশ সহজ ছিল ইসরায়েলের পক্ষে। সেজন্যই তো হামলা চালিয়ে সুরক্ষিতভাবে বিমানগুলি ফিরেও এসেছে। যারা এতদিন বলতো ইসরায়েল কোনওদিনও নিজের সীমান্ত অতিক্রম করে ১হাজার কিলোমিটার দূরে ইরানে ঢুকে হামলা চালাতে পারবে না, তাদেরকেও ভুল প্রমাণিত করে দিয়েছে ইসরায়েল। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলির দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে- যেখানে যেখানে হামলা চালানো হয়েছে, প্রত্যেকটা জায়গাই সীমান্ত থেকে ১হাজার থেকে ষোলশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল প্রমাণ করে দিল যে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ষোলশো কিলোমিটার দূরেও আঘাত হানতে সক্ষম। ইরানের যেসব জায়গাগুলিকে নিশানা করা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে নতাঞ্জ। এটি হল সেই জায়গা যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছিল ইরান। এছাড়াও রয়েছে ইরানের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর সাইট- প্লুটোনিয়াম ও ইউরেনিয়ামের রিসার্চ সেন্টার, নিউক্লিয়ার ল্যাব, ইরানের মিলিটারি কম্যান্ড হেডকোয়ার্টার, তাদের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডের এয়ারবেসকেও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ইরানের সেনাবাহিনীর প্রধানদেরও হত্যা করা হয়েছে এই হামলার মাধ্যমে। এর মধ্যে ছিলেন ইরানের চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল মহম্মদ বাগেরি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা খামেনেই-র পর দেশের সর্বোচ্চ কম্যান্ডার ছিলেন তিনিই। ইরানের তিন সেনার উপরে বসেছিলেন তিনি। সেই মহম্মদ বাগেরিকেও হত্যা করা হয়েছে। চারদিকে আঁটোসাঁটো নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও, সংশ্লিষ্ট হেডকোয়ার্ডারের মিটিং রুমে ঢুকে তাঁকে খতম করেছে ইসরায়েল। ইরানের সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেন সালামিকেও হত্যা করা হয়েছে এই হামলার মাধ্যমে। ইরানের সবচেয়ে বড় মিলিটারি ফোর্সের প্রধানকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এখানেই শেষ নয় ইরানের সেনার ডেপুটি কম্যান্ডার জেনারেল রশিদ সহ সর্বোচ্চ স্তরের আধিকারিকদের হত্যা করা হয়েছে এই অপারেশন রাইসিং লায়নের মাধ্যমে মাত্র একদিনে। যে দেশের সেনা প্রধান এবং চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফের একদিনে মৃত্যু হয়, তার কতটা শোচনীয় অবস্থা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেখানে ইরানের পারমাণবিক বৈজ্ঞানিকরা থাকেন, সেইসব বাড়িকেও নিশানা করেছে ইসরায়েলের যুদ্ধ বিমানগুলি। হামলায় মৃতদের মধ্যে ছিলেন ইরানের অ্যাটোমিক এনার্জি অর্গ্যানাইজেশনের প্রাক্তন প্রধান ফেরেদুন আব্বাসি। এছাড়াও তেহরানের ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী মহম্মদ মেহেদিকেও হত্যা করা হয়েছে। এই দুই ইরানি বিজ্ঞানি নিজেদের ঘরেই ছিলেন। ভেবেছিলেন ঘরের ভিতরে একেবারে সুরক্ষিতই আছেন, কিন্তু এমনটা হয়নি। ইজরায়েলের তরফে আরও দাবি করা হয়েছে, এই হামলা এতটাই সুনির্দিষ্ট ছিল, যে কোনও সাধারণ মানুষ এই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হননি। এবার প্রশ্ন হচ্ছে এমন হামলা কেন চালাল ইসরায়েল ? কেন ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করা হল ?
ইসরায়েলের দাবি, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য ইউরেনিয়াম ধাতুকে ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধ করা হয়। এমনটা করে ফেলতে পারলেই সেই দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। ইরান এর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। ইউরেনিয়ামে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতা ইতিমধ্যে এনে ফেলেছিল ইরান। আগামী কয়েক মাসে ইরান পারমাণবিক পরীক্ষা করে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে নিতে পারতো। এই বিষয়ে খবর পেয়ে গিয়েছিল ইসরায়েল। সেজন্যই ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র, তাদের উচ্চপদস্থ বৈজ্ঞানিক এবং সেনা আধিকারিকদের হত্যা করল ইসরায়েল। বর্তমানে ইরানের অবস্থা এমন যে পাল্টা হামলা চালানোর ইচ্ছা থাকলেও সেনা প্রধানদের মৃত্যুর কারণে তার উপায় নেই। এই হামলা নিয়ে সরাসরি প্রকাশ্যে এসে কথা বলছেন খোদ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু। তাঁর মুখে উঠে এসেছে একটি কথা যা হল- নিউক্লিয়ার হলোকস্ট। যার অর্থ হল- এমন পারমাণবিক হামলা। যার জেরে পুরো দেশ বা পুরো সভ্যতা বিপন্ন হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের সঙ্গেও এমনটাই হয়েছিল। এমনই হলোকস্টের মাধ্যমে ৭ লক্ষ ইহুদির হত্যা করেছিল হিটলার। ইহুদিদের জন্য একটি শিবির বানানো হয়েছিল। যেখানে নরকযন্ত্রণা দিয়ে তাঁদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। আরেকটা হলোকস্টের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেজন্যই এই হামলা চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। একবার ইহুদিদের এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক, সেটা কাম্য নয়, জানাচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানইয়াহু।
মধ্যপ্রাচ্যে মোট ১৬টি দেশ আছে। সেখানে ইসরায়েল এমন একটি দেশ যেখানে বহু অমুসলিম মানুষের বসবাস। এরা ইহুদি ধর্মে বিশ্বাসী। অনেকেই বিষ্মিত এই ভেবে যে, যেখানে চারদিকে ১৫টি মুসলিম দেশ, সেখানে ইসরায়েলের মতো ছোট দেশ ইরানের উপর এমন হামলা কীভাবে চালাল?
মানচিত্রে চোখ রাখলে বোঝা যায় ইরানের আয়তন ১৬ লক্ষ ৪৮ হাজার ১৯৫ বর্গ কিলোমিটার। সেখানে ইসরায়েলের আয়তন মাত্র ২১ হাজার ৯৩৭ বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ ইরান ইসরায়েলের চেয়ে ৭৫ গুণ বড়। অর্থাৎ ৭৫টি ইসরায়েল এক হলে ইরানের সমান হবে। ইসরায়েলের জনসংখ্যা মাত্র ৯৫ লক্ষ। অন্যদিকে ইরানের জনসংখ্যা ৯ কোটি ২৪ লক্ষ। অর্থাৎ জনসংখ্যার দিক থেকেও ইরান অন্তত ১০টি ইসরায়েলের সমান। তাতে কী ? ইসরায়েল ইরানের ভিতরে ঢুকে যে হামলা চালিয়ে দেখিয়ে দিল, তা এইসব হিসেবকে গুলিয়ে দিতে বাধ্য। ইসরায়েলকে ইসলাম ধর্মের জন্য বিপজ্জনক বলে দাবি করে ইরান। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের একটাও দেশ ইরানের পাশে নেই। দেশগুলি হামলার নিন্দা করেছে ঠিকই কিন্তু ইরানকে সামরিক সাহায্য দিতে কেউ এগিয়ে আসেনি। শুধুমাত্র সমালোচনা করেই পিছিয়ে গিয়েছে। ইসরায়েলের বায়ুসেনা ইরাক, জর্ডন, সিরিয়া এবং সৌদি আরবের মতো দেশকে পেরিয়ে ইরান পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এখানেই শেষ নয় সীমান্তের ষোলশো কিলোমিটার দূরে ঢুকে হামলাও চালালো। এরপরও এসব দেশের থেকে কোনও সাহায্য পেল না ইরান। ইসলাম ধর্মের উপর ভর করে যখন ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করছে ইরান, তখন তার পাশে নেই প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলি। কারণ একটি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশ হতে চায় ইরান। এটাই তাদের স্বপ্ন। যেসব দেশের কাছে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে- আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইসরায়েল, রাশিয়া, চিন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং পাকিস্তান। এইসব দেশগুলিও জানে আগামীদিনে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে নিতে পারলে তাদেরকেও ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। সেজন্য ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার পরও ভিতরে ভিতরে খুশি এইসব দেশ।
১৯৪৮ সালে যখন ইজরায়েল তৈরি হয় তখন তারাও জানত যে তারা খুব ছোট একটা দেশ। কোনও দেশের সঙ্গে যুদ্ধ হলে তাদের ধ্বংস হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। এই ভেবেই নিজেদের সেনা, নিজেদের গুপ্তচর সংস্থা এবং সমরাস্ত্রগুলিকে উন্নত করতে থাকে ইসরায়েল। বর্তমানে ইসরায়েলের হাতে এমন সব প্রযুক্তি রয়েছে, যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে না বড় বড় দেশগুলিও। দেশ ছোট হলেও প্রযুক্তির উপর ভর করে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়, তা আরও একবার প্রমাণ করে দিল ইসরায়েল।