ওয়েব ডেস্ক : ব্রিটেনে রক্ষণশীলরা বিপুল হারে ভোটে জিতেছে। এমনকী, বিরোধী লেবার পার্টিরও অনেকে ব্রেক্সিট ইস্যুতে শিবির পালটেছে। ১৯৩৫ সালের পর এত খারাপ ফল ব্রিটেনের লেবার পার্টির হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে গাঁটছড়া কাটার ভরসা পেয়েছেন। জেতার পর তিনি বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য ব্রিটেনের মানুষের স্বার্থ দেখা। বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টিকে এবার বহু ব্রাউন সাহিব-মেম সাহিব ভোট দিয়েছেন। একঝাঁক ভারতীয় এমপি পেয়েছেন বরিস জনসন। তাতে অবশ্য বিজয় মাল্য-নীরব মোদির মতো ফেরারিদের ভারত নির্ঝঞ্ঝাটে হাতে পাবে কি না সন্দেহ। আপাত খাতির-ভদ্রতার আড়ালে দেশটার অভিজাতদের অবস্থা তো এখনও বহুলাংশে লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’-দেরই অভিজাতদের মতো। পদে পদে ভণ্ডামির রাজত্ব।
আরও পড়ুন : নেপালে বাস দুর্ঘটনায় মৃত ১৪ শরনার্থী, আহত ১৮
ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাণিজ্য ব্যবস্থা নতুন করে গড়ে উঠলে ভবিষ্যতে কী হতে পারে, আর তাতে ভারতের মতো দেশের অর্থনীতি কী ধরনের সুবিধা পেতে পারে, সে কথা বড় বড় অর্থনীতিবিদ বলতে পারবেন। তবে, ব্রিটেনের রাজকোষে যে পরিমাণ সোনা মজুত আছে তাতেই বিশ্বে পাউন্ডের মূল্যমান নির্ধারিত হয়। পাউন্ডের দাম ডলারের চাইতে বেশি। ব্রিটিশ রানির তোষাখানায় মজুত সোনার সিংহভাগই গিয়েছিল ভারত থেকে। রেপ অফ বেঙ্গল নিয়ে দাদাভাই নওরোজি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দেওয়ার পর এবং রমেশচন্দ্র দত্ত ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ‘ভারতের অর্থনীতির ইতিহাস’ লেখার পরেও ব্রিটিশ রাজের অধীনস্থ মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য ঘোচেনি। ফলে, ব্রিটেনের তোষাখানায় সোনার বাটেও ভাটা পড়েনি। ইদানীং, পশ্চিমী গবেষকরাই কেউ কেউ ব্রিটিশ রাজরক্ত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
আরও পড়ুন : মা কে ধাক্কা মারল গাড়ি, রাগে গাড়িটিকেই লাথি ক্ষুদের
এক-একজন তো এমন কথাও বলছেন, এখন ব্রিটেনের সিংহাসন যাঁদের জিম্মায় তাঁদের ধমনীতে মুসলমান রক্ত আছে। এসব গবেষণার অবশ্য কোনও মানে হয় না। কে কাকে আবেগে জাপটে ধরবে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে, আগে ব্রিটেন ও ইউরোপের বিভিন্ন রাজবংশের মধ্যে জ্ঞাতিসম্পর্ক ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েও নিজেদের মধ্যে তারা পিসি-মাসি, ভাই-ভাতিজা সম্বোধনে চিঠি চালাচালি করত। লাল রক্তের চাইতে অবশ্য নীল রক্তে রহস্য বেশি। এই অবস্থায় কার ধমনীতে কার রক্ত বইছে তা কে বলতে পারে! আভিজাত্য-রাজরক্তের রহস্য আমাদের দেশেও যেমন, অন্য দেশেও তেমন। অন্ধকার হয়ে গেলেই সে এক মারাত্মক রহস্যময় ব্যাপার-স্যাপার! জ্যাক দ্য রিপার ব্রিটিশ রাজবংশেরই সন্তান, একটা সময় তো এ রকম সন্দেহও ওই দেশের অনেক লিবারেল মানুষের মনে দানা বেঁধেছিল। অন্য দেশের মানুষের ঘাড়ে মোটা ট্যাকসো চাপিয়ে রাজদণ্ড ঘোরানোর বিষ মাথায় উঠলে কীভাবে ঝেড়ে কাশতে হয় কিংবা কোন পদ্ধতিতে ঝেড়ে কাপড় পরাতে হয়, সেটা প্রথম দেখিয়ে দিয়েছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। দেশটা আমাদের, এবার তোমরা এস, এই কথায় যখন কাজ হল না তখন শুরু হল স্বাধীনতার যুদ্ধ। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র হার মানল। আমেরিকায় জন্ম নিল সাধারণতন্ত্র। আমেরিকার স্বাধীনতার আদর্শ বুকে নিয়ে ফ্রান্সে ফিরলেন লাফায়েত। সেখানেও ঘটল রাজতন্ত্র-বিরোধী বিপ্লব। কিন্তু ভারতের মতো রাজারাজড়া-নবাব-সুলতানের দেশে ব্রিটিশ আভিজাত্যের ছোঁয়াচ কাটিয়ে বাঁচা দুঃসাধ্য। ইংরেজি শিখেছি, জামা-প্যান্ট-বুটজুতো-পুলওভার পরছি, এই যথেষ্ট। আর কিছু দরকার নেই। বাকিটা আমরাই চালিয়ে নিতে পারব। এ কথা বললে পাছে জাত যায়! অতএব পশ্চিমবঙ্গের রেকর্ডধারী মুখ্যমন্ত্রী
জ্যোতি বসু ফি-বছর দুবার করে লন্ডনে যেতেন। একবার তো তিনি ট্রাফালগার স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে সাট্টা ডন রশিদ খানের ফ্যামিলির সঙ্গে ছবিও তুলেছিলেন। তার জন্য অবশ্য সাট্টা ডন রশিদ খানকে গাঁটের কড়ি কিংবা পাপের কড়ি খরচা করতে হয়েছিল। মানে, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে ছবি তোলার জন্য সাট্টা ডনকেও কাটমানি দিতে হয়েছিল। অথচ, যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা ঠেলে ভারত সাধারণতন্ত্র হওয়ার পর এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে কমনওয়েলথে ঢোকার ছাড়পত্র আদায় করার পর পণ্ডিত নেহরু যখন লন্ডনে গিয়েছিলেন তখন কিন্তু ভারতীয় হাই-কমিশনের ২৬ জানুয়ারির আমন্ত্রণ ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ বয়কট করেছিল। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকার ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের তাড়ায় আমেরিকার গ্যাংস্টাররা নাম ভাঁড়িয়ে ব্রিটেনে পালিয়ে যেত। কারণ তারা জানত, সেখানে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া তুলনায় সহজ, সুপারিও মেলে বেশি। হয়তো ব্রিটিশ আইনের ফাঁকফোঁকর গলে তারা পার পেয়ে যেত।
একবিংশ শতকে বরিস জনসনের নতুন ব্রিটেনে কি সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে? ব্রিটিশ ভারতীয় এমপি-রা হয়তো সে ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন। তবে, ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সূত্রেই জানা গিয়েছে, ব্রিটেনে নতুন করে খালিস্তানিদের বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে। খালিস্তানি-অখালিস্তানি সকলেই ইউনিয়ন জ্যাককে কুর্নিশ করে, লং লিভ দ্য কুইন গায়। ব্রিটিশ আইন মেনে চলে। ফলে, ব্রিটিশ ববি তাদের কিছু বলে না। মাঝখান থেকে ব্রিটিশ পাকিস্তানিদের ডেরায় সাপের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেই সাপগুলো যত দিন না ২০০৫ সালের ৭ জুলাইয়ের মতো সরাসরি ব্রিটিশদের ছোবল মারছে, তত দিন ব্রিটেনে তাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু ভারতবাসীর দুশ্চিন্তা বাড়বে।