সোমবার চতুর্থ দফার নির্বাচন রয়েছে রাজ্যের আট আসনে। এই আটটি আসনের মধ্যে পাঁচটি আসন রয়েছে তৃণমূলের দখলে। দুটিতে বিজেপি ও একটি আসন কংগ্রেসের দখলে। এই আট আসনের অন্তর্গত ৫৬ টি বিধানসভার অধিকাংশই এখন তৃণমূলের দখলে।
সঞ্জু সুর, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ- প্রথম তিন দফায় রাজ্যের দশটি আসনের ভোট হয়ে গিয়েছে। বাকি ৩২ টি আসনের মধ্যে আগামি সোমবার চতুর্থ দফায় ৮ টি আসনে ভোট হবে। ভাগ্য নির্ধারণ হবে বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট প্রার্থীর। এই দফায় নির্বাচনী লড়াই তে রয়েছেন কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী, রয়েছেন তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র, শতাব্দি রায়, কীর্তি আজাদ, শত্রুঘ্ন সিনহা, বিজেপির জগন্নাথ সরকার, দীলিপ ঘোষ, এস এস আলুওয়ালিয়া।
এক নজরে দেখে নিই এই আট কেন্দ্রে ২০১৯ এর ফল কেমন ছিলো।
কেন্দ্র বহরমপুর। টানা এই কেন্দ্রে জিতে আসছেন কংগ্রেসের অধীর রঞ্জন চৌধুরী। এবার অবশ্য বেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি। তৃণমূল কংগ্রেস এখানে প্রার্থী করেছে প্রাক্তণ জাতীয় ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান কে। লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছেন বিজেপির চিকিৎসক প্রার্থী ডঃ নির্মল কুমার সাহা। ফলে ত্রিমুখী লড়াই হতে চলেছে কংগ্রেসের গড় বলে পরিচিত বহরমপুর কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে এই মুহূর্তে ছয়টি রয়েছে তৃণমূলের দখলে। শুধু বহরমপুর বিধানসভা রয়েছে বিজেপির দখলে। একটিও বিধানসভা কংগ্রেস বা জোট সঙ্গী বামেদের দখলে না থাকলেও ফের একবার এখান থেকে জয়ের বিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিত অধীর চৌধুরী। ২০১৯ সালে বহরমপুর কেন্দ্রে মোট ভোট পড়েছিলো ৭৯.৪১ শতাংশ। অধীর চৌধুরী ৪৫.৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অপূর্ব সরকারকে পরাজিত করেছিলেন ৮০,৬৯৬ ভোটের ব্যবধানে। টানা এতদিন এই কেন্দ্র থেকে জিতলেও শেষ তিনটি নির্বাচনে কিন্তু ক্রমশঃ কমেছে অধীর চৌধুরীর ভোট প্রাপ্তির হার, যা তাঁকে চিন্তায় রাখবে।
কেন্দ্র কৃষ্ণগর। দলীয় সাংসদ মহুয়া মৈত্র কে লোকসভা থেকে বহিষ্কার কে হাতিয়ার করে তৃণমূল কংগ্রেস ফের একবার তাঁকেই এই কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে। ২০০৯ সাল থেকে কেন্দ্রটি রয়েছে জোড়া ফুলের দখলে। ২০১৯ সালে মোট ৮৩.৭৫ শতাংশ ভোটের মধ্যে মহুয়া মৈত্র পেয়েছিলেন প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোট। তবে ২০০৯ থেকে এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ক্রমশঃ কমেছে, যা চিন্তায় রাখবে মহুয়া মৈত্র কে। এই কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে খাতায় কলমে ছয়টি রয়েছে তৃণমূলের দখলে। তবে ২০২১ এর নির্বাচনে কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে মুকুল রায় জয়ী হলেও পরে ফিরে যান জোড়া ফুল শিবিরে। ফলে সেই অর্থে সাতটিই বর্তমানে তৃণমূলের দখলে। বিজেপি এখানে প্রার্থী করেছে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির সদস্য অমৃতা রায় কে। রাজবাড়ির আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোটে জেতার চেষ্টা বলেই মনে করছেন অনেকে। পাশাপাশি মহুয়া মৈত্র-র ব্যবহার নিয়ে জোড়া ফুল শিবিরের মধ্যেই রয়েছে অসন্তোষ। যদিও ভোটে সেসব কিছুই প্রভাব ফেলবে না বলেই দাবি কৃষ্ণনগরের তৃণমূল নেতাদের। এই কেন্দ্রে বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থী করেছে পোড় খাওয়া নেতা এস এম সাদি কে। তাঁর প্রচারে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলেই দাবি লাল শিবিরের।
বীরভূম আরেকটি হেভিওয়েট কেন্দ্র। এখানে চতুর্থ বার সাংসদ হওয়ার লড়াইতে নেমেছেন তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়। এই কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে ছয়টি রয়েছে তৃণমূলের দখলে, দুবরাজপুর কেন্দ্রটি রয়েছে পদ্মের হাতে। ২০১৯ এ ভোট পড়েছিলো ৮৫.৩৪ শতাংশ, যার মধ্যে মহুয়া মৈত্র পেয়েছিলেন ৪৫.১৩ শতাংশ। এতগুলো বিধানসভা দখলে থাকলেও নিজের দলের দ্বন্দ চিন্তায় রাখছে শতাব্দী রায় কে। পাশাপাশি অনুব্রত মণ্ডল জেলে থাকায় ভোটের দিন ভোট মেশিনারি সুচারু ভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ নেতার অভাব শতাব্দী রায়কে বিপাকে ফেলতে পারে। এদিকে বিজেপিও খুব একটা স্বস্তিতে নেই। তাদের ঘোষিত প্রার্থী দেবাশীষ ধরের মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় শেষ মূহুর্তে তড়িঘড়ি দেবতনু ভট্টাচার্য কে প্রার্থী করে সামাল দিতে হয়েছে। তবে শতাব্দী রায়ের চিন্তার অন্যতম কারণ রয়েছে বাম কংগ্রেস জোটের প্রার্থীকে নিয়েও। স্থানীয় কংগ্রেস নেতা, হাসন কেন্দ্রের প্রাক্তণ বিধায়ক মিলটন রশিদের জনপ্রিয়তা (বিশেষ করে সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে) যদি ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হয় তাহলে চার তারিখ পদ্ম প্রার্থী চওড়া হাসি হাসতেই পারেন।
রানাঘাট লোকসভা আসন এবারও নিজেদের দখলে রাখার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য লড়াইতে নামতে হয়েছে বিজেপির বিদায়ী সাংসদ জগন্নাথ সরকারকে। যদিও এই কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভার মধ্যে খাতায় কলমে পাঁচটি বিধানসভা পদ্মফুলের দখলে রয়েছে। দুটি বিধানসভা নবদ্বীপ ও শান্তিপুর আছে তৃণমূলের দখলে। তবে নির্বাচন ঘোষনা পর্বে রানাঘাট দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক মুকুট মনি অধিকারী হঠাৎ করেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে একেবারে লোকসভার প্রার্থী হয়ে গিয়েছেন। ভোটের মুখে এইভাবে দলবদল অবশ্য মুকুট মনি অধিকারীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ফলে তাঁকে অনেকটাই নির্ভর করতে হচ্ছে জোড়া ফুলের সাংগঠনিক দক্ষতার উপর। ২০০৯ ও ২০১৪ সালে তৃণমূলের পক্ষে রায় দেওয়ার পর ২০১৯ এ কিন্তু এই আসন বিজেপির দখলে আসে। ওই বছর প্রায় ৫২.৭৮ শতাংশ ভোট নিয়ে তৃণমূল প্রার্থী রুপালি বিশ্বাস কে দুই লক্ষেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেছিলেন জগন্নাথ সরকার। এবারও তাঁর উপরেই ভরসা রেখেছে পদ্ম শিবির।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হলো আসানসোল। ২০১৯ এর নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী মুনমুন সেনের বিরুদ্ধে একপ্রকার জোর লড়াই করে আসনটি নিজের দখলে রেখেছিলেন বাবুল সুপ্রিয়। সেই বাবুল সুপ্রিয়-ই পরে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিলে ২০২২ এর উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী করে শত্রুঘ্ন সিনহা কে। সেই উপ নির্বাচনে বিজেপির ঘরে থাকা ৫১.১৬ শতাংশ ভোট কমে গিয়ে বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পল মাত্র ৩০.৪৬ শতাংশ ভোট পান। শত্রুঘ্ন সিনহার জয়ের ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় ৩,০৩,২০৯ ভোটে। এবারও তৃণমূলের প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহা। উল্টোদিকে এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রথমে প্রার্থী করেছিলো ভোজপুরি গায়ক পবন সিং কে, যা নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়। পরবর্তী সময় পবন সিং সরে দাঁড়ালে একেবারে শেষ মুহূর্তে এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী করে এস এস আলুওয়ালিয়া কে। ২০১৯ এ আলুওয়ালিয়া পদ্ম প্রার্থী হিসাবে বর্ধমান-দূর্গাপুর তৃণমূলের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এবার তাঁকে সেই আসনে আর প্রার্থী করা হয় নি। এই কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভার মধ্যে পাঁচটি রয়েছে তৃণমূলের দখলে আর দুটি কেন্দ্র, কুলটি ও আসানসোল দক্ষিণ রয়েছে বিজেপির দখলে। ২০১৯ এর ট্র্যাক রেকর্ড এবারও আলুওয়ালিয়া বজায় রাখতে পারেন না কি বিহারী বাবু শত্রুঘ্ন সিনহা তাঁকে ‘খামোশ’ করেন সেটাই এখন দেখার।
রাজ্য রাজনীতির এক অন্যতম বিতর্কিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ নেতা হলেন দিলীপ ঘোষ। বিজেপি এবার তাঁকে ২০১৯ এ তাঁর জেতা আসন মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে আলুওয়ালিয়ার কেন্দ্র বর্ধমান-দুর্গাপুরে প্রার্থী করেছে। দিলীপ ঘোষের লড়াই কিন্তু খুবই কঠিন। কারণ ২০১৯ এ এই কেন্দ্রে বিজেপির জয়ের মার্জিন ছিলো রাজ্যের দ্বিতীয় ন্যুনতম( মাত্র ২,৪৩৯ ভোটের ব্যবধান)। এই কেন্দ্রের সাতটির মধ্যে দুর্গাপুর পশ্চিম ছাড়া বাকি ছয়টিই তৃণমূলের দখলে। ২০০৯ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় বামেদের দখলে থাকার পর ২০১৪ সালে জোড়াফুল ঘুরে ২০১৯ এ পদ্মফুলের পক্ষে রায় দিয়েছে এই কেন্দ্র। এবার কেন্দ্রটি বিজেপির দখলে রাখতে তৃণমূল কংগ্রেসের আরেক প্রাক্তণ ক্রিকেটার কীর্তি আজাদের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইতে নামতে হয়েছে পোড়খাওয়া বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষকে।
পরপর দুইবার (২০০৯,২০১৪) বর্ধমান পূর্ব থেকে জোড়া ফুলের টিকিটে জয়ী হওয়ার পর এবার আর টিকিট পান নি বিদায়ী সাংসদ সুনীল কুমার মন্ডল। তাঁর বদলে রাজনীতির ময়দানে নতুন মুখ নিয়ে এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই কেন্দ্রে এবার তাদের প্রার্থী চিকিৎসক শর্মিলা সরকার। বিজেপি প্রার্থী করেছে বিধায়ক অসীম সরকারকে। ২০১৯ এ এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছিলো প্রায় ৮৪.৭৮ শতাংশ।
বোলপুর কেন্দ্রে এবারও তৃণমূল প্রার্থী করেছে বিদায়ী সাংসদ অসিত মাল কে। ২০১৯ এ প্রায় এক লক্ষের বেশি ভোটে এই কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে টানা এই বোলপুর আসনটি রয়েছে ঘাস ফুলের দখলে। সাতটি বিধানসভাই রয়েছে তৃণমূলের হাতে। ফলে এবারও আসনটি নিজেদের দখলে রাখার ব্যাপারে চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী জোড়াফুল শিবির।
আরও পড়ুন – অধীর গড়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ, স্লগ হিটার ইউসুফ, গলার কাঁটা নির্মল সাহা