রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তারাশঙ্কর বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত লেখকদের বই সরকারি স্কুলের লাইব্রেরিতে থাকত। এবার সরকারি লাইব্রেরিতে থাকবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ১৯ টি করে বইও। শিক্ষা দফতরের এমনই নির্দেশিকায় প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষকমহলের একাংশ।
নাজিয়া রহমান, সাংবাদিক- সরকারি বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে কি কি বই রাখা হবে তার একটা খসড়া তৈরি করেছে শিক্ষা দফতর। বই রাখার বিষয়ে শিক্ষা দফতরের তরফে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে ৷ সেই বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যের ২৩টি জেলাকে পাঁচটি বইয়ের সেট বা তালিকায় ভাগ করা হয়েছে। প্রথম সেটে যেসমস্ত জেলা গুলি আছে- আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি দার্জিলিং, কালিংপঙ্ক, মালদা, শিলিগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর। দ্বিতীয় সেটে রয়েছে যেসমস্ত জেলাগুলি- বাঁকুড়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া। তৃতীয় সেটে আছে- দক্ষিণ দিনাজপুর, হুগলি, নদিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর। চতুর্থ সেটে আছে- ব্যারাকপুর, হাওড়া, কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। পঞ্চম সেটে যে জেলাগুলির নাম রয়েছে- উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর। ভাগ করে দেওয়া তালিকা জেলা পরিদর্শকের কাছে পাঠানোও হয়েছে । সেই তালিকায় যেমন দেশবিদেশের নামী লেখক লেখিকাদের লেখা বই-এর নাম রয়েছে তেমনই রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বইও । স্কুলের গ্রন্থাগারে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা বই নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
প্রসঙ্গত, শিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে গ্রান্থাগারে রাখা বই এর জন্য টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ২০২৬টি স্কুলকে গ্রন্থাগারের বই কেনার জন্য এক লক্ষ টাকার করে দেবে শিক্ষা দফতর বলে জানা গেছে । যে অর্থ দিয়ে পাঁচটি করে সেটের এই বইগুলি কিনতে হবে স্কুলগুলিকে । তালিকায় মোট রয়েছে ৬০০র বেশি বই । আর পাঁচটি সেটের প্রতিটি সেটে রয়েছে আলাদা আলাদা বই । সেই বই-এর সেটে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা ১৯টি বইএর নাম রয়েছে। তালিকায় মুখ্যমন্ত্রীর লেখা বই থাকায় শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী বলেন, ‘‘রাজ্যের স্কুলগুলির লাইব্রেরির জন্য অর্থ অনুদানের পাশাপাশি ৫১৫ টি বই লাইব্রেরীতে রাখার শর্ত দিয়েছে রাজ্য সরকার। তার মধ্যে ১৯ টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের লেখা বই! আমরা নজিরবিহীন এই নির্দেশের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অবিলম্বে এই শর্ত তুলে নিতে হবে।
পরাধীন ভারতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালীন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার স্বাধিকার হরণের শর্ত দিয়েছিল ইংরেজ শাসক। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজ আমরা স্বাধীন দেশে শাসকের একই রকম পদধ্বনি শুনছি। এ অত্যন্ত লজ্জার। লাইব্রেরীর মতো পবিত্র জায়গায় সরকারি অনুদানের সঙ্গে কোন শর্ত চাপিয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে আমরা। পাশাপাশি এই শর্ত প্রত্যাহার করার দাবী জানাচ্ছি।’’ অন্যদিকে বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডলেরও বক্তব্য ,” সরকারি পয়সায় আমাদের রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বই বিভিন্ন বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পাঠানো হচ্ছে। এটা শুনে আমরা অবাক হলাম। এটা সত্যিই একটা বিস্ময়কর ঘটনা। আমারা মনে করতে পারছি না যে, আমাদের রাজ্যে বা অন্য কোনও রাজ্যে স্বপদে বহাল থাকাকালীন এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার বলে আমরা মনে করি। এই সিদ্ধান্ত যদি শিক্ষা দফতর নিয়ে থাকে, আর মুখ্যমন্ত্রীর যদি অনুমোদন না থাকে, তাহলে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর উচিত হবে যে শিক্ষা দফতর নির্দেশ দেওয়া তাঁর লেখা কোনও বই যাতে লাইব্রেরিতে না পাঠানো হয়।”
তবে পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির রাজ্য সভাপতি বিজন সরকার বলেন,”মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। রাজনীতি করেন বলে তাঁর বই লাইব্রেরিতে রাখলে কি অসুবিধে? আমি তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট দেখতে পেয়েছি তাঁর বইতে। কিন্তু প্রশ্ন হল বাম আমলে গণশক্তি রাখা হলে কোনও প্রশ্ন ছিল না,দেশের প্রধানমন্ত্রীর নামে স্টেডিয়াম হলে কোনও বিতর্ক হয় না। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই আসলে বাণিজ্যিক ভাবে সফল। তো পাঠককে ঠিক করতে দেওয়া হোক, পাঠক বাণিজ্যিকভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়বে, কি পড়বে না। সেটা তাদের উপর দেওয়া আমার মনে হয় ভালো হবে।”
যেসমস্ত বই স্কুলের লাইব্রেরিতে থাকবে বলে জানা গেছে, সেগুলি হল-জানা গিয়েছে,আমার পাহাড়, আমার জঙ্গল, চোখের তারা, জীবন সংগ্রাম, এক পলকে এক ঝলকে,কুৎসাপক্ষ , সেরা মমতা (প্রথম ও দ্বিতীয়) একতারা, সোজাসাপ্টা, কথায় কথায়, পরিবর্তন, নন্দী মা, অনশন কেন, অশুভ সংকেত, অনুভূতি, কন্যার চোখে কন্যাশ্রী, বিকেলটা হারিয়ে গেছে ৷ এছাড়া লাইব্রেরিতে থাকতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একাধিক বই। মোট ১৯ টি করে বই থাকার কথা জানা গেছে। শিক্ষা দফতরের তরফ থেকে গ্রন্থাগারে রাখার জন্য যে বই-এর তালিকা পাঠানো হবে সেই তালিকা অনুযায়ি বই রাখতে হবে বলেই মত স্কুলের প্রধান শিক্ষক শিক্ষিকাদের। নারান দাস বাঙ্গুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় বড়ুয়া বলেন, ” সরকারি অনুদান খরচ করতে গেলে অবশ্যই সরকারি নির্দেশ ও পরামর্শ মেনে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখানে বিদ্যালয়ের ব্যক্তিগত কোনো পছন্দ অপছন্দের জায়গা নেই।”