রথে চাপবেন স্বয়ং জগন্নাথ দেব। পুরীতে উপচে পড়বে ভিড়। ভক্তরা ভিড় জমাবেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কিন্তু, রথের রশিতে টান দেওয়ার আগে একবার জেনে নেওয়া যাক, কে এই জগন্নাথ দেব।
প্রবীর মুখার্জী, সাংবাদিক : সামনেই রথযাত্রা। মহাধুমধাম করেই পালিত হয় দিনটি। এই রথযাত্রা মানেই পুরী। আর পুরী মানেই জগন্নাথ দেব। এখন প্রশ্ন হল কে এই জগন্নাথ দেব। অনেকে মনে করেন, মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা যেখানে শেষ, তার পরেই শুরু জগন্নাথ দেবের লীলা। তবে বেদে কিন্তু, জগন্নাথ দেবের কোনও উল্লেখ সেভাবে নেই। দশাবতারেও নামোল্লেখ নেই জগন্নাথ দেবের। যদিও ওড়িয়া গ্রন্থে জগন্নাথ দেবকে বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে ভগবান বুদ্ধের (বুদ্ধদেব কিন্তু, বিষ্ণুর অবতার) জায়গায় বসানো হয়েছে। যাঁরা পুরী বা শ্রীক্ষেত্রে গিয়েছেন। তাঁরা কিন্তু দেখেছেন, বিষ্ণুর দশাবতারের যে মূর্তি দেখতে পাওয়া যায় , সেখানে নবম অবতারে জগন্নাথ দেব। অর্থাৎ সেখানে বুদ্ধদেবের কোনও মূর্তি নেই। গবেষকদের একাংশের মতে ওড়িষার আদিম আদিবাসী শবর ছিল বৃক্ষের উপাসক। তারা তাদের দেবতাকে ‘জগনাত’ বলতেন। হয়তো বা সেই থেকই এসেছে ‘জগন্নাথ’ শব্দটি।
অনেকে আবার মনে করেন নীলাধবের পরম ভক্ত শবর উপজাতির রাজা বিশ্বাবসুর বংশধর হলেন ‘দৈতাপতি’। পুরীর মন্দিরের প্রধান দায়িত্ব পাল করেন এই দৈতাপতিরাই। তা সে গুন্ডিচা যাত্রাই হোক, বা নবকলেবর বা শ্রীঅঙ্গসেবা। তাঁরা ঈশ্বরের পরিবার নামেও পরিচিত হন। বিদ্যাপতির বংশধরেরা আবার মহাপাত্র,পতি হিসেবে পরিচিত। তাঁরাও কিন্তু, এই রথযাত্রা বা নবকলেবরে মহপ্রভুর আরাধনার বিশেষ দায়িত্ব পেয়ে থাকেন।
জগন্নাথ দেবের আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে খুব জনপ্রিয় কাহিনী প্রচলিত রয়ছে। একটি কাহিনী সবাই জানেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্মের সামনে আবির্ভূত হয়ে পুরীর সাগরপাড়ে ভেসে আসা দারুবৃক্ষ দিয়ে তাঁর মূর্তি তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। আর সেই মূর্তি তৈরি করেছিলেন এক কাষ্ঠশিল্পীর বেশধারী স্বয়ং বিশ্বকর্মা। শর্ত ছিল যতক্ষণ না মূর্তি তৈরি সম্পূর্ণ হচ্ছে, ততদিন তাঁকে কেউ বিরক্ত করবেন না। কেউ খুলতে পারবেন না মন্দিরের দরজা। কিন্তু, তাঁর সেই শর্ত রাখতে পারেন নি অত্যুৎসাহী রানি। মূর্তি তৈরি শুরু করার মাত্র ৬ থেকে ৭ দিন পরেই দেবমূর্তি দর্শনের জন্য কাতর হয়ে মন্দিরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন রানি মা। দেখেন সেখানে নেই শিল্পী। মূর্তির হাত-পা তখনও নির্মাণই হয় নি। ঠিক সেই সময়েই দেবর্ষি নারদ রাজার সম্মুকে উপস্থিত হয়ে সেই অর্ধসমাপ্ত মূর্তিই পুজো করার নির্দেশ দেন। তিনিই জগন্নাথ এই কথা আমরা কমবেশি প্রায় সকলেই জানি। রয়েছে আরও একটি কাহিনী।
বৃন্দাবনে গোপীরা কোনও একদিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলা ও তাঁদের কৃষ্ণপ্রেম নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে দায়িত্ব দেন তাঁদের কথা যেন দাদা শ্রীকৃষ্ণ ও বড়ভাই বলরাম বা বলভদ্র শুনতে না পান। তাই সুভদ্রাকেই দায়িত্ব দেন দাদারা আসলেই যেন তাদের জানান দেন ভগিনী। আসলে গোপীদের ধারনা ছিল, সব কথা আড়ি পেতে শুনে নেন কৃষ্ণ। তাই এই পন্থাই নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু, তিনি যে অন্তর্যামী। গোপীদের আলোচনা চলছে কৃষ্ণের প্রেম-প্রীতি ও লীলা নিয়ে। নিজের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে মগ্ন সুভদ্রাদেবীও। কেউই দেখতে পেলেন না কখন যেন কৃষ্ণ আর বলরাম তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছেন। গোপীদের কথা শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ের হাত-পা গেল গুটিয়ে। আনন্দে চোখ দুটো রসগোল্লার মতো হয়ে উঠল। এমনকি সেই রূপ দেখা গেল বোন সুভদ্রার মধ্যেও। সেই থেকেই নাকি জগন্নাথ বলভদ্র আর সুভদ্রার এই রূপ।