সহজ ভাষায় বলতে গেলে, দেশগুলি যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, সেইসব বিষয়ে আলোচনা করার জন্যই এই সামিটের আয়োজন করা হয়। যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে নতুন নতুন নীতি তৈরি করাটাই হল মূল লক্ষ্য।
মাম্পি রায়, সাংবাদিক- জি-সেভেন অর্থাৎ গ্রুপ অফ সেভেন। মোট ৭টি দেশ রয়েছে এই জি-সেভেনে। আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্স এবং জাপান। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই জি-সেভেনের অংশ। ভারতকে অতিথি দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় এই জি-সেভেন সামিটে।
ইতিমধ্যে জি-২০-তে সফলভাবে সভাপতিত্ব করেছে ভারত। এহেন ভারত কেন জি-সেভেনের সদস্য নয়? সেটাই বড় প্রশ্ন । এবার দেখা যাক এই জি-সেভেনের অধিবেশন কেমন হয়-
জি সেভেনের বার্ষিক সম্মেলনের দুটো অধিবেশন হয়। প্রথম হল কোর সামিট, দ্বিতীয়টি হল আউটরিচ সেশন। কোর সামিটে ওই ৭টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রনেতারা সামিল হন, যারা জি-সেভেনের স্থায়ী সদস্য। আউটরিচ সেশনে বিশেষ অতিথিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাই অতিথি দেশ হিসেবে জি-সেভেনের আউটরিচ সেশনে যোগ দেয় ভারত। ভারত ছাড়াও অতিথি দেশগুলির তালিকায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউক্রেন। এই দেশগুলিও জি-সেভেনের স্থায়ী সদস্য নয়। তবে জি-সেভেনের সভাপতিত্ব করা কানাডা এই দেশগুলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এছাড়াও জি-সেভেনের আউটরিচ সেশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে রয়েছেন ন্যাটো, রাষ্ট্রসংঘ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের প্রধানরাও।
এই ধরণের সামিট কেন হয় ?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, দেশগুলি যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, সেইসব বিষয়ে আলোচনা করার জন্যই এই সামিটের আয়োজন করা হয়। যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে নতুন নতুন নীতি তৈরি করাটাই হল মূল লক্ষ্য। যেভাবে আমাদের দেশের বিভিন্ন গ্রামে আর্থিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য পঞ্চায়েতের আয়োজন করা হয়, ঠিক তেমনই বিশ্বের বড় বড় দেশগুলি বছরে একবার আর্থিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বৈঠক করে। সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয় আর্থিক বিষয়ের উপর। আর্থিক বিষয়টিকে লক্ষ্য রেখেই এই সংগঠনের নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে রমজান মাসে ইজরায়েল এবং আরব দেশগুলি মধ্যে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। যাকে বলে রমজান যুদ্ধ। বর্তমানেও ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ইজরায়েল। ওইসময়েও ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল ইজরায়েল। আমেরিকা এবং বেশিরভাগ পশ্চিমী দেশ ইজরায়েলকে সমর্থন করেছিল। এর জেরে ক্ষুব্ধ হয়ে আমেরিকা এবং পশ্চিমী দেশগুলিকে কাঁচা তেল সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। সবচেয়ে বড় তেল সংকট হয়েছিল। যার জেরে বড় অর্থনীতির দেশগুলিকেও আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছিল। পরবর্তীকালে এইসব বাম-বিরুদ্ধ দেশগুলি প্রথমে জি-সিক্স গঠন করে। তারপর নতুন দেশ সংযুক্ত হওয়ার পর জি-সেভেনে পরিণত হয় সংগঠনটি। জি-সেভেনের সপ্তম দেশটি হল কানাডা। ২০২৫ সালে কানাডাই জি-সেভেনের সভাপতিত্ব করছে। এই সংগঠনটি তৈরির পর থেকে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ছিল এর সদস্যরা।
১৯৭০ সালে এই সাতটি দেশের জিডিপি ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি ছিল। ১৯৭৫ সালে তা হল ৬৩ শতাংশ, ১৯৮৫ সালে তা বেড়ে হয় ৬৫ শতাংশ, ১৯৯৫ সালে সারা বিশ্বের জিডিপির ৬৬ শতাংশ ছিল এই ৭ দেশের পকেটে। সেসময়ও গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে মজবুত সংগঠন ছিল এটি। সারা বিশ্বের অ্যাজেন্ডা সেট করতো এই ৭টি দেশ। কারণ সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে ধনী ছিল এই দেশগুলি। কিন্তু বর্তমানে ছবিটা অন্য। জি-সেভেনের পরিস্থিতি বর্তমানে তেমন নেই যেমনটা আগে ছিল। এই ৭দেশের জিডিপি ৬৬ শতাংশ থেকে হয়েছে ২৯ শতাংশ হয়েছে। বর্তমানে জি-সেভেন সংগঠনের সদস্যদের তালিকায় সবচেয়ে নীচে রয়েছে কানাডা ও ইটালি। অর্থব্যবস্থার নিরিখে এই দুই দেশের জি-সেভেনের তালিকায় থাকারই কথা নয়। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে আমেরিকা, দ্বিতীয় স্থানে চিন, তৃতীয় স্থানে জার্মানি এবং ভারত রয়েছে চতুর্থ স্থানে। কিন্তু চিন, জার্মানি এবং ভারত জি-সেভেনের স্থায়ী সদস্য নয়। যেসময়ে এই সংগঠনটি তৈরি করা হয়েছিল সেইসময় দেশগুলিতে সবচেয়ে বড় অর্থব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বর্তমানে কানাডা, ইতালি আর সেই জায়গায় নেই। বরং তাদের জায়গা সহজেই নিতে পারে চিন, ভারত। ভারত সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। সহজেই জি-সেভেনের স্থায়ী সদস্য হতেই পারে। এই সংগঠনে শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক দেশই এর সদস্য হতে পারে। অর্থব্যবস্থার নিরিখে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হলেও চিন জি-সেভেনে থাকতে পারে না, কারণ চিনে গণতন্ত্র নেই। এরপরও রাশিয়া ও চিনকে জি-সেভেনে অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে পশ্চিমী দেশগুলির মধ্যে ব্যাপক বিবাদ শুরু হয়েছে। শৈত্যযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাশিয়া যখন আলাদা রাষ্ট্র হয়ে গেল, ১৯৫৮ সালে জি সেভেন জি-এইট হয়ে যায়। রাশিয়া ছিল অষ্টম দেশ। ২০০৬ সালে জি-এইটের সম্মেলনে হাজির ছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ইউক্রেনের ক্রিমিয়াকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিল, তখন আমেরিকা সহ পশ্চিমী দেশগুলি রাশিয়াকে জি-এইট থেকে বের করে দেয়। এই সংগঠন জি-এইট থেকে জি-সেভেন হয়ে যায়। যদিও এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানাচ্ছেন সেইসময় রাশিয়াকে জি-এইট থেকে বের করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। রাশিয়া জি-এইটে থাকলে, হয়তো ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ হত না। কূটনৈতিক দিক থেকে রাষ্ট্রপতি পুতিন ও ট্রাম্প একে অপরকে শত্রু মনে করেন। এখন রাশিয়াকে জি-সেভেনে যুক্ত করার কথা বলছেন ট্রাম্প। যদিও এই দেশগুলি জি-সেভেনের এই মঞ্চেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ে মজা করেছিলেন। ২০২২সালে জার্মানিতে জি-সেভেনের আয়োজন হয়েছিল। ওই মঞ্চেই পুতিনের একটি ছবি নিয়ে মজা করেছিলেন তাঁরা। যেখানে খালি গায়ে ঘোড়ায় চেপে ছবি তুলেছিলেন পুতিন।
এছাড়াও, ২০০৯ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত জি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন, শক্তি এবং খাদ্য নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের সাথে আলোচনা করেন।
এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বও। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, ২০১৪ সালের আগে জি-৮-এ মনমোহন সিংকেও ডাকা হত, তাঁর কথা শোনা হত। ২০০৭ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত এমনই এক সম্মেলনে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিখ্যাত সিংহ-মের্কেল সূত্র তৈরি হয়েছিল। আর মোদীর আমলে আগে ভারতের বহু দিনের বিদেশনীতিকে আমেরিকার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারাই নাকি ভারত পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছে বলে ক্রমাগত বলে চলেছে।