ওয়েব ডেস্ক : ইতিহাস এক বিচিত্র বস্তু। বলার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইতিহাসকে দেখার প্রয়াস শুরু হয়েছিল পাশ্চাত্যে। পরবর্তীকালে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রভাব বাড়ে। তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসকে দেখার যে চেষ্টা সেটা পশ্চিমা দুনিয়ারই শিক্ষা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘কৃষ্ণচরিত্র’ লিখেছিলেন পশ্চিমী ঐতিহাসিকদের সঙ্গে তর্ক করবেন বলে। দেখাতে চেয়েছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র। কাল্পনিক চরিত্র নন। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তিনি সেই ঐতিহাসিক রচনা লিখেছিলেন, তা পশ্চিমা দুনিয়ারই তর্কপদ্ধতি। স্বামী বিবেকানন্দের ইতিহাস-দর্শনও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ারই ফল।
ইতিহাস লিখতে নেমে যদি কেউ আগে থেকেই ধরে নেয় যে, যা জানি সেটাই শেষ জানা। অজানা কিছু নেই। এবং, আমি যা ধরে নিয়েছি তার বাইরে কোনও প্রমাণ থাকতে পারে না। তাহলে তো ইতিহাস আর ইতিহাস থাকে না, সেটা রামায়ণ-মহাভারত, ইলিয়াড-ওডিসি হয়ে যায়। যা নাই ভারতে তা নাই ভারতে। মহাভারতে যা নেই, ভারতেও তা থাকতে পারে না। এই ধরনের মতের সঙ্গে জার্মানরাই শ্রেষ্ঠ মানবজাতি, চিনই পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু-স্বর্গীয় সাম্রাজ্য, মার্কসবাদ সত্য কারণ তা বিজ্ঞান, কিংবা গোটা পৃথিবীতে ইসলাম না প্রতিষ্ঠিত হলে শান্তি আসবে না, ইত্যাদি মতবাদের কোনও ফারাক নেই।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে ইতিহাসের সঙ্গে ইতিহাসবিদ্যার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সে এক বিরক্তিকর অধ্যায়। কৌতূহল বাড়ার বদলে বুক শুকিয়ে আসে। প্রশ্ন জাগার বদলে ক’ দিস্তে উত্তরপত্র লিখতে হবে ভেবে গলদঘর্ম হতে হয়। তার ওপর আবার ইদানীংকালে ইতিহাস লেখার একটা ফ্যাশন হল অর্থনীতির ইতিহাস। সেই অর্থনীতির ইতিহাস রমেশচন্দ্র দত্ত-র ভারতের অর্থনীতির ইতিহাস নয়। ইদানীং কালের অর্থনীতির ইতিহাসের বইগুলি অমর্ত্য সেনের মতো নোবেলজয়ী ছাড়া আর কারওরই হয়তো ভালো লাগবে না। বাম আমলে প্রকাশিত সেইসব ইতিহাস বইয়ের কোনও কোনওটিতে আবার নীল বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টিই নেই। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় সেগুলি ছেপে বেরিয়েছিল।
প্রথম এনডিএ আমলে কিছু ইতিহাসবিদ স্থির করেছিলেন, এতদিনকার ভারত-গবেষণার গতিমুখ ঘুরিয়ে দিতে হবে। ফলে, তাঁরা উঠেপড়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে, আর্যরা বাইরে থেকে এদেশে আসেনি, তারা এদেশেই ছিল। যদিও তাঁদের তত্ত্ব কিংবা তথ্য কোনওটিই ধোপে টেঁকেনি। এখন আবার সে রকম একটা প্রয়াস গোটা ভারত জুড়েই চলছে। সেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের টিকি-পৈতে রাখার বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনীয়তা। কিংবা, কাঁচা ডিম-গরম দুধ খাওয়ার ফলপ্রদ বলকারক উপযোগিতা। যদিও আমেরিকা-ইউরোপে অনেকেই ঠান্ডা দুধ খায়। সেটাও আবার টিভিতে দেখে এদেশে অনেকে খেতে আরম্ভ করে দিয়েছে! কাচের গেলাসে। স্টিলের গেলাসে খেলে হবে না। সেইসঙ্গে টিভি দেখে সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি, স্মাইলিং বুদ্ধ এবং জোডিয়াক রিংও কিনছে। রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’ যখন টিভিতে দেখানো হত তখন অনেকে টিভির পর্দার সামনে ধুপধুনো জ্বালিয়ে পুজো করত। রবিবার সকালে সেই অঘোষিত কার্ফুর সময় সুযোগ বুঝে গেরস্ত বাড়িতে অনেকে আবার চুরিও করত। দ্বিতীয় শ্রেণিই বোধহয় সব চাইতে বস্তুবাদী ছিল। এখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের দাপটে তারা সংখ্যালঘু বলে বিতাড়িত হতে পারে।
ফুটপাথে বই নিয়ে যাঁরা বসেন, সেখানেও এখন ঐতিহ্যের দাপট। সিনেমা পত্রিকা-ফ্যাশন ম্যাগাজিন, কুক-বুকের পাশাপাশি ইংরেজিতে জাতক, হিতোপদেশ, শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের বাল্যকাল (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অন্য লীলা আছে), চোখের পক্ষে পীড়াদায়ক রংয়ে ছাপিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। বইগুলি আগেও ছিল। কেউ পড়তে বারণ করেনি। হঠাৎ এখনই কেন এত ঐতিহ্যের বেগ? যারা এইভাবে ভারত-ঐতিহ্য তুলে ধরতে চায়, তারাই কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলিতে গিয়ে সেক্স শপ খোঁজে। কিংবা পকেটে পয়সা থাকলে কল গার্ল, সোসাইটি গার্ল চায়। আরবের শেখদের মতো। ঐতিহ্যের তাগিদে একদল ৪৪০ কোটি টাকা খরচা করে বল্লভভাই প্যাটেলের দৃষ্টিকটু মূর্তি বসিয়েছে গুজরাটে, আর একদল খোঁপাবাঁধা কোনও এক পৌরাণিক বীরের আরও দৃষ্টিকটু মূর্তি বসিয়েছে কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দ রকে। এত সংকীর্ণতা নিয়ে ভারতভূমি টিঁকবে কী করে?
ঘুরেফিরে সেই ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রেই ফিরতে হয়। কমলাকান্তের আফিম সেবন, সেইসঙ্গে রসবতী গোয়ালিনীর কাছে দুধ কেনা। এর প্রভাবে খোয়াব দেখে যদি নব্য ভারতের রথী-মহারথীরা সমাজকে কষাঘাত করতেন, তাহলে কিছু বলার থাকত না। কিন্তু তাঁরা ভারতবাসীকে এমন এক আফিম সেবন করাতে চাইছেন যার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে। গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্তকে নিয়ে ইতিহাসচর্চা এক জিনিস। কিন্তু রামচন্দ্রকে ঐতিহাসিক চরিত্র ধরে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস রচনার অর্থ নব্য প্রস্তর যুগে ফিরে যাওয়া। এ রকম গা-জোয়ারি ভারতবাসীই ক্ষমা করবে না। ইতিহাস রচনায় অর্ধসত্যের কোনও জায়গা নেই।