Date : 2024-04-25

ক্রিসমাসের মুখে কলকাতা পুলিশের কাজ বেড়েছে

ওয়েব ডেস্ক : একটা সময় ক্রিসমাসের কলকাতা সত্যিই বর্ণময় ছিল। সাধারণ নাগরিকের জেবে এত পয়সা তখন ছিল না। কারণ, ক্রিকেটে অবৈধ বেটিংয়ের মতো জুয়ার অবাধ রাজত্ব ছিল না। আলাদা করে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের আসর বসত না। তবে, নেহরুর জন্মদিন উপলক্ষে গোর্কি সদনে ছোটদের চলচ্চিত্র উৎসব হত। দেখানো হত পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অ্যানিমেশন ফিল্ম। দেখার জন্য পয়সা দিতে হত না। সময়মতো কার্ড জোগাড় করতে হত। ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ। গোর্কি সদনেই দেখানো হয়েছিল প্রথম বাংলায় ডাবিং করা ভিনদেশি ফিল্ম। ‘বাহাদুর ছেলে’। ছেলেবুড়ো সবাইকেই উদ্বুদ্ধ করার মতো সাদা-কালো ফিল্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটা ছোট্ট ছেলে ভায়োলিনের বক্সে মেশিনগান নিয়ে নাৎসি বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে পার্টিজানদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন : বর্ষশেষের রাতে বাজানো যাবে না ডিজে, বন্ধ আতসবাজি

পার্টজান বাহিনীতে তার বাবাও ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রায় এক দশক বাদে সেই সিনেমা নকল করে তৈরি হয়েছিল ‘দ্য ভায়োলিন’। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চ্যালাচামুণ্ডারা সেই ফিল্ম নিয়ে নন্দন চত্বরে খুব তোড়ফোড় করেছিল। ‘বাহাদুর ছেলে’র কথা তারা জন্মেও শোনেনি। কলকাতায় ছোটদের প্রথম রোবটও দেখানো হয়েছিল গোর্কি সদনে। সেই রোবট ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা সব ভাষাতেই ছোটদের স্বাগত জানিয়েছিল। তার ইস্পাতের হাতে ছিল নানা রঙের কাগজ আর পালকের ফুল। তখন ইডেন গার্ডেন্সে যুব উৎসব হত, মিলিটারি টাট্টু হত। আবার টেস্ট ক্রিকেটও হত। মোটাসোটা গিন্নিরা সিট জুড়ে থেবড়ে বসে উলের কাঁটা নিয়ে সোয়েটার বুনতেন, গালগল্প করতেন। সোয়েটার কতখানি বোনা হল তা দেখার জন্য যখন সেটা তুলে ধরতেন তখন একটা দারুণ শট কিংবা কারও বোল্ড আউট হয়ে যাওয়া মিস করতে হত। দূরদর্শনে ক্রীড়া সম্প্রচার সেই দুঃখ ঘুচিয়েছিল। টেস্ট ক্রিকেটের আসরে নেপোটিজমের ব্যাপার তখনও ছিল।

আরও পড়ুন :বাড়িতে পড়ে থাকা ৩ কেজি প্লাস্টিক দিলেই ফ্রিতে পাবেন পেঁয়াজ

ভারতের মতো দেশে অবশ্য স্বজনপোষণ থাকবেই। চাকরি-বাকরি থেকে সব কিছুতেই। কিন্তু  ক্রিকেটারদের ড্রেসিং রুমে দাউদ গ্যাংয়ের উৎপাত তখনও পর্যন্ত ঢোকেনি। শীতের ছুটিতে এসপ্লানেড আর গঙ্গার ধার ছিল সাধারণ মধ্যবিত্তের কাছে একফালি অক্সিজেনের মতো। তখন তো আর সেলফির যুগ আরম্ভ হয়নি। আমরা সকলেই প্রতিভাবান, এমন কথা কেউ ভাবতেও পারত না। সাধারণ নাগরিকের কেক খাওয়া বলতে ছিল ‘জলযোগ’। ‘জলযোগে’র কুমির। চোখ দুটোয় চেরি বসানো। ফারপো-টারপো বইয়ে পড়া অভিজাত আড়ষ্টকাঠ ব্যাপার। বহুকাল আগে কলকাতায় এসে রাশিয়ান গোলকিপার লেভ ইয়াসিন সাংবাদিক ও খেলোয়াড়দের বলেছিলেন, এখানে শীত এত সুন্দর, অথচ আপনারা শীতের সময় ফুটবল খেলেন না কেন? আর ক্রিকেটের মতো একটা অলস খেলাই বা খেলেন কেন? আমরা তাঁকে বলতে পারিনি, আমরা বাঙালিরা আসলে বিলিতি কেতায় বিশ্বাসী।

ব্রিটেনের সায়েবরা আমাদের প্যাচপেচে গরমে আর বর্ষায় কাদা মেখে ফুটবল খেলতে শিখিয়ে গিয়েছেন। তাই আমরা ওই সময়টাতেই ফুটবল খেলি। আর শীতে খেলি ক্রিকেট। সায়েবরা খেলতেন। মেমেরা দেখতেন। তেনারা যা শিখিয়ে গিয়েছেন, আমরা তাই তাই করি। বিলেতে কেউ গেলেই সে আমাদের চোখে ভালো। বিলেত থেকে কেউ ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে ফিরলেও সে ভালো। বিলেতে আমাদের যেতেই হবে। না হলে কলকে পাওয়া যাবে না। ভালো ইংরেজি জানলেও পাওয়া যাবে না, ভালো ইংরেজি বই পড়লেও পাওয়া যাবে না। শেষে ডোন্ট-কেয়ার সমর সেনের মতো গোল্ড মেডেল বেচে ‘ফ্রন্টিয়ারে’র মতো কাগজ করতে হবে। আমরা আসলে অনেকটা চার্লস ডারউইনের মিসিং লিঙ্কের মতো।

আরও পড়ুন :২ জানুয়ারি থেকে পরিবর্তিত বাসরুটের ফাঁসে শহর!

ডারউইন সাহেব ওই লিঙ্কটা খুঁজে পাননি। কারণ, তিনি ‘বিউগল’ জাহাজে চড়ে গ্যালাপ্যাগোস আইল্যান্ডসের দিকে গিয়েছিলেন। কলকাতার দিকে এলে মিসিং লিঙ্কটা পেয়ে যেতেন। এই মিসিং লিঙ্ক সুপার এপদের ভালো নকল করতে পারে। যদিও সাহেবদের চাইতে একটা ব্যাপারে এদের মাথা বরাবরই সাফা। সেটা হচ্ছে অপরাধে। ভারতভূমি ছাড়া এত অপরাধমনস্ক জাতি অন্য কোথাও দেখা গিয়েছে কি না সন্দেহ। ১৯২৮ সালে কলকাতার তৎকালীন অ্যাডিশনাল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ই এইচ কিজ এক সাক্ষাৎকারে ‘ক্রাইম অ্যান্ড রিলিজিয়াস বিলিফস ইন ইন্ডিয়া’র লেখক অগাস্টাস সমারভিলকে হতাশ হয়ে বলেছিলেন, এই শহরে কোকেন পাচারকারী নেটিভরা পুলিশের চোখে ধুলো দিতে এতটাই সফল যে, তাদের দমন করতে নেমে কাস্টমস আর পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে।

কিজ-এর মতে, নষ্টামির বুদ্ধিতে ব্রিটেন সহ ইউরোপের অপরাধ জগত এদের কাছে নিতান্ত শিশু। কিজ এ কথা বলার বহুকাল আগে অবশ্য রবার্ট ক্লাইভ বিলাপ করে লিখেছিলেন, “বাংলার মাটিতে নিশ্চয়ই ইভিল আছে। না হলে মাদ্রাজে থাকতে আমাকে দুর্নীতি গ্রাস করেনি। কলকাতায় গ্রাস করল কী করে?” যদিও ক্লাইভই গুড ফ্রাইডের রাতে এই কলকাতায় হঠাৎ এক অপার্থিব উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখেছিলেন। যা দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, স্বয়ং খ্রিস্টের আশীর্বাদ। এর কিছু দিন বাদে অবশ্য তিনি আত্মহত্যা করেন। আজকের কলকাতায় পুলিশগিরি আরও কঠিন ব্যাপার।

২৫ ডিসেম্বরের মুখে এক প্রভু যিশুর আশীর্বাদ না-মিললে হয়তো বিশ্ববিপ্লবী কিংবা ধর্মের ধ্বজাধারী অপরাধ জগতের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া অসম্ভব। চারিদিকে ‘ও মধু ও মধু আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ’ রব। পুলিশের মাথা ঘুরতে বাধ্য। উল্কির মাধ্যমেও তরল সিনথেটিক নারকোটিক শরীরে প্রবেশ করানো যায়। আর তার পর? অ্যাগনি অ্যান্ড এক্সট্যাসি। পথও অনেক, উপায়ও অনেক। আর কিছু না পেলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে ক’ মিনিট লাগে?