Date : 2024-04-26

রাষ্ট্রদ্রোহিতা-র দণ্ড দিতে হলে পুলিশকে ফ্রি-হ্যান্ড দিতে হয়

ওয়েব ডেস্ক : ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা অর্থাৎ সিডিশন নিয়ে সরকারের কাছে একটি কনসালটেশন পেপার জমা পড়েছিল। যে ল কমিশন এই পেপার তৈরি করেছিল তাতে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী এবং প্রফেসর ছিলেন। তাঁরা বিলেত-আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আইনের উদাহরণ তুলে দেখিয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের সঙ্গে ওই দেশগুলিতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার পার্থক্য কোথায়।

আরও পড়ুন :রেলের ওভার হেড ধরে অঙ্গভঙ্গি, তার পর যা হল

আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলিতে গণতন্ত্র অনেক উদার। তারা দেশদ্রোহিতার সংজ্ঞাকে এখন যেভাবে বিচার করে ভারতে সেভাবে বিচার করা হয় না। ব্রিটেন তো এখন সিডিশন ল তুলে দেওয়ারই পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও সত্তরের দশকে এই ব্রিটেনেই বিখ্যাত গায়ক ব্রুস স্প্রিংস্টিনের ‘আয়ারল্যান্ড ফর আইরিশ’ গানটির সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ওই গানকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমার্থক বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। যেহেতু তখন আইরিশ রিপালিকান আর্মির বিপ্লবীদের বোমাতঙ্কে সত্তর-আশির দশকে গোটা ব্রিটেন তটস্থ ছিল। আইরিশ বিপ্লবীদের বোমা বিস্ফোরণে মাউন্টব্যাটেন নিহত হন।

আরও পড়ুন: এক কোলে সন্তান অন্য কোলে প্রকৃতি! ২০ লক্ষ গাছের ‘সিঙ্গিল মাদার’ ইনি

সত্তরের দশকেই ভারতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনি ধারাকে আরও সময়োপযোগী করার জন্য কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়। তার মধ্যে একটি প্রস্তাব ছিল, শুধু রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ নয়, রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চাওয়ার অভিসন্ধি নিয়ে কেউ যদি প্ররোচনা দেয়, তাহলে তাদেরও রাষ্ট্রদ্রোহিতার আওতায় আনতে হবে। কিন্তু তখন ওই প্রস্তাবে সরকার সাড়া দেয়নি।

বরাবরই কমবয়সের ছেলেমেয়ে, তরুণ-তরুণীরা ‘বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে’, ‘সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে’। সুকান্ত ভট্টাচার্যের অসাধারণ কবিতার লাইন। কিন্তু তাদের লণ্ডভণ্ড করার প্ররোচনা দেয় কারা? কারা চায়, ভারত ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাক, কিংবা দিকে দিকে লেগে যাক ভয়াবহ দাঙ্গা? মানুষ কাটাকাটি করে মরুক, ভিটেজমি ছেড়ে পালাক, জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া হোক, সুপার এপ আবার এপ হয়ে যাক? এরা কিন্তু দিব্য বেঁচে থাকে। পরের দিন আবার ঘণ্টা নাড়ে, শেয়ার বাজারের ভাউ জানতে চায়, দোকান খোলে, পার্টি অফিসে বসে খবরের কাগজ পড়ে কিংবা টিভি নিউজ দেখে। এদের খাদ্যের অভাব হয় না। ধোয়াকাচা জামাকাপড় ইস্তিরি করিয়ে পরে। জুতোয় পালিশ করায়।

আরও পড়ুন : প্রি ওয়েডিং ফটোশ্যুটে CAA ও NRC বিরোধী প্রতিবাদ, ভাইরাল ছবি

রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে এদের ধরে খাঁচায় পোরার জন্যই সত্তরের দশকে রাষ্ট্রের ক্ষতি করার অভিসন্ধির শর্তটা ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ঢোকানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কারণ, এরাই যুব সমাজকে অপরাধ করতে উসকানি দেয়। দুঃখের বিষয়, ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তখন এই প্রস্তাবে আমল দেয়নি। দিলে হয়তো পরবর্তীকালে ভারতের দিকে দিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের তাণ্ডব দমনে তাঁকে ব্যস্ত হতে হত না। হাজার হলেও শান্তিনিকেতনের স্কুলিং। তায় ভারতমাতা। বিষ মাথায় না-ওঠা পর্যন্ত নামাতে হয়তো কষ্ট পেয়েছিলেন। ছোবল মারার আগেই বিষদাঁত ভেঙে দিতে পারতেন ১২৪এ-তে স্রেফ ওই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিসন্ধির শর্তটা ঢুকিয়ে।

লেখা কিংবা বক্তৃতার মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহিতায় উসকানি দেওয়ার সঙ্গে রক্তপাত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই একের পর এক জীবনদায়ী প্রতিষেধকের আবিষ্কার ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষের গড় আয়ু বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রসূতি মৃত্যু কমছিল। শিশুরা বাঁচছিল, হাসছিল। কারও কারও হয়তো সেটা পছন্দ হচ্ছিল না। অতএব বলকান অঞ্চলে শুরু হল নরমেধ যজ্ঞ। স্বাধীনতাকামী সার্ব, ক্রোটদের শায়েস্তা করতে অটোমান তুর্কি বাহিনী নামল ভয়াবহ গণহত্যায়। আসল উদ্দেশ্য ছিল, জায়গা খালি করা। তোমরা থাকবে না। আমরা থাকব। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। একটা ছুতোর দরকার। তোমার সম্পত্তিতে আমি হাত দিতে পারছি না। কোনও ভাবেই পারছি না। ভেবেছিলাম বসে বসে পয়সা পিটব। কিন্তু তুমি খেটে যা রোজগার করছ, আমি তা পারছি না। অতএব তোমাকেই পিটি। পিটলে তুমি চটে যাচ্ছ? তাহলে তোমাকে মেরেই ফেলি। ব্যস, তোমার জায়গাটা আমার হয়ে গেল! গুহামানবরা যা করত একেবারে সে রকমই ব্যাপার।

খালি কোনও একটা ইজমের নাম দিলেই হল। এই ইজম বা মতবাদের নাম করে যারা কমবয়সীদের খ্যাপায়, রাষ্ট্রদ্রোহিতায় ওসকায়, তাদের খাঁচায় পোরার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনকে চোস্ত করা দরকার। ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক মতবাদ, যে কোনও দিক থেকেই মানুষকে যে রাষ্ট্রদ্রোহী করে তোলা যায়, পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ থেকে মথুরায় রামবৃক্ষ যাদব বাহিনীর কীর্তি সবেতেই তার প্রমাণ মিলেছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় বাকুনিন-ক্রপোটকিন, হিটলার-মুসোলিনি, স্তালিন-মাও সে তুংদের সংখ্যা বেড়েছে। মাদাম মাও-কাং শেংদেরও অভাব নেই। এদের নেশার দ্রব্যও লাগে। অপকার-অন্যায় সুস্থ মস্তিষ্কে তো আর করা যায় না। তুলনায় নিরাপত্তা বাহিনী কম। সোপ অপেরার ধামাকায় পড়াশোনা-দেশাত্মবোধও লাটে উঠেছে। এখন চারিদিকে নানা রকমের বাই। দাও, খালি দাও। যেখান থেকে পার এনে দাও। চুরি করো-ডাকাতি করো, দাও! ব্র্যান্ডেড জিনিস চাই! নিতান্ত দেহাতি-গাঁওয়ার ছাড়া কেউই চায় না, ঘরের ছেলে পুলিশ-মিলিটারিতে যাক।

হিলারি ক্লিনটনরা আবার গাইতে বলে গিয়েছেন, শহুরে শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়েরা মর্দানি হোক। আমরাও প্রাণপণে তা গাইছি। একের পর এক সুখের ঘর ভেঙে দিচ্ছি। বউরা খরখরে হয়ে উঠছে। কমবয়সী মেয়েরা সোপ অপেরা দেখে দেখে চোখ-মুখ ঘুরিয়ে টরটরে হচ্ছে। চাইল্ড রেপ বাড়ছে। যদিও পিঁয়াজ আপাতত কিলোপ্রতি ১৪০ টাকা।

মোরারজি দেশাইয়ের আমলে পিঁয়াজের দাম বাড়ায় দিল্লির মানুষ বলত, সব পিঁয়াজ কান্তি দেশাই খেয়ে ফেলেছে। কান্তি দেশাই মোরারজি দেশাইয়ের ছেলে। কান্তি দেশাইয়ের দুর্নীতি নিয়ে রাজধানীতে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল। অথচ, ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ভ্রষ্টাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেই জনতা পার্টিকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। নিন্দুকেরা অবশ্য বলত, জনতা পার্টিকে দিল্লির ক্ষমতায় বসিয়েছিল নাসবন্দি নিয়ে গ্রামে গ্রামে অপপ্রচার। নাসবন্দির প্রকল্প ইন্দিরা গান্ধী করেছিলেন জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে। মানুষ যদি করতে হয়, দুটির বেশি মোটেই নয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ কম বয়সে দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলেন।

মোরারজি দেশাইকে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়া উল-হক সেদেশের সর্বোচ্চ সম্মান দেন। পরে আমেরিকার সাংবাদিক সেমুর হার্শ লেখেন, মোরারজি দেশাই আমেরিকার গুপ্তচর হিসাবে সিআইএ-র পে রোলে ছিলেন। মোরারজি তাঁর বিরুদ্ধে আমেরিকার আদালতে মানহানির মামলা করেন। কিন্তু হার্শ যে তাঁর মানহানি করেছেন তেমন কোনও প্রমাণ মোরারজি দিতে পারেননি। মামলা খারিজ হয়ে যায়। এই ধরনের গণ্যমান্য-দেশবরেণ্যদের হাতে ভারতের ভবিষ্যৎ বাঁধা থাকলে আগামী দিনে বোধহয় মক্কার ‘রক্ষক’দের কথাতেই আমাদের উঠতে-বসতে হবে। চোখে সুরমা লাগাতে হবে। পুলিশকে বোরখা পরে ঘুরতে হবে। কারণ তাঁরাই তেল দেন। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিসন্ধির সংযোজনে তাঁরা কি খুশি হবেন?