Date : 2024-04-25

তালিবানি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এখন আমেরিকারই বড় বিপদ

ওয়েব ডেস্ক : তালিবানি আক্রমণে আফগানিস্তানে সোমবার ভোরের আগেই ১৪ জন মিলিশিয়াম্যান মারা গিয়েছেন। স্থানীয় মানুষকে নিয়ে তৈরি এই নিরাপত্তা বাহিনীকে আমেরিকার সেনারা অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছে। কিন্তু তালিবানি আক্রমণের সঙ্গে তারা এঁটে উঠতে পারছে না।

আরও পড়ুন : ফিরে দেখা ২০১৯: এবছরের দেখা ৬টি সেরা বাংলা ছবির গল্প

রবিবার তালিবানি হামলায় ১৭ জন আফগান মিলিশিয়াম্যান মারা যান। শুক্রবার ১০ জন আফগান সেনার মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার ছয়জন আফগান সেনা নিহত হন। গত সপ্তাহের সোমবার তালিবানিরা রাস্তার ধারে এক বিস্ফোরণ ঘটায়। তাতে আমেরিকার একজন সেনা নিহত হন। ওই সপ্তাহেই একটি চেক পয়েন্টে তালিবানিদের আক্রমণে নিহত হন আফগান সেনাবাহিনীর সাত ফৌজি। পরিস্থিতি যা, তাতে যে কোনও ভাবে একটা রফা চাইছে আমেরিকা। যাতে তারা তাদের অবশিষ্ট বাহিনীকে আফগানিস্তান থেকে তুলে আনতে পারে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা-র সময় থেকেই এই প্রয়াস শুরু হয়েছিল। ধাপে ধাপে যাতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটোর সেনা সরিয়ে আনা যায়। এখন আমেরিকা তাদের বাহিনীর শেষ দলটিকেও সরিয়ে আনতে চাইছে। কিন্তু তালিবানিদের সঙ্গে রফার কোনও সূত্র এখনও পর্যন্ত মেলেনি। ১৮ বছর হয়ে গেল, আফগান সংকটের চোরাবালি থেকে আমেরিকা বের হতে পারছে না।

আফগানিস্তানের প্রায় অর্ধেক এখন বিভিন্ন তালিবানি গোষ্ঠী ও ইসলামিক স্টেটের ঘাতকদের কবলে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি নাগাদও গৃহযুদ্ধে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর পাল্লা ভারী ছিল। বিভিন্ন প্রদেশের তালিবানি ডেরায় হানা দিয়ে তারা সন্ত্রাসবাদীদের খতম করছিল। কখনও মিলিশিয়া বাহিনীর কাছ থেকে খবর পেয়ে তাদের আস্তানায় অব্যর্থ লক্ষ্যে বোমা বর্ষণ করেছিল আমেরিকার বিমান বাহিনী। মাঝখানে তালিবানিরা রফায় রাজিও হয়। তাদের প্রতিনিধি দল মস্কোয় গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করে। তালিবানিদের আর একটি প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটন যাবে বলেও স্থির হয়। তালিবানিদের শর্ত, আগে আমেরিকান বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ুক, তবে কথা। আমেরিকা চাইছে, একটি জাতীয় সরকারের চুক্তি করে তবে আফগানিস্তান ছাড়তে। আফগানিস্তানের যা অবস্থা, তাতে শান্তিরক্ষায় সেখানে আন্তর্জাতিক বাহিনী পাঠাতে চাইছে না রাষ্ট্রসংঘ। আমেরিকার প্রশাসন বলেছে, শান্তিবাহিনীর সিংহভাগ খরচ তারা বইবে, কিন্তু সেনা দিতে পারবে না। আমেরিকাবাসী চাইছেন না, তাঁদের ছেলেমেয়েরা আফগানিস্তানে মরতে যাক। আমেরিকার শর্তে রাষ্ট্রসংঘের আর কোনও দেশই রাজি হচ্ছে না। এমনকী, ভারতও ডোনাল্ড ট্রাম্প-কে ‘না’ বলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন: ফিরে দেখা ২০১৯: ফণী থেকে এনআরসি, রাজ্য রাজনীতির সাতকাহন

রাশিয়ার প্রভাব ঠেকাতে এক সময় এই তালিবানিদের মাথায় তুলেছিল আমেরিকাই। তখন তারা ভাবেনি, আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের খুনি উপজাতি গোষ্ঠীগুলির অপরাধপ্রবণতা দীর্ঘকাল ধরেই একটা মিথ হয়ে গিয়েছে। তখন সৌদি আরব সহ শেখশাহির অর্থানুকূল্যে পাকিস্তানি সামরিক গুপ্তচর বাহিনীকে তালিম দিয়ে, এইসব উপজাতি গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে কট্টরপন্থী মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ব্রিগেড তৈরি করিয়েছিল সিআইএ। অর্থ জোগানের জন্য মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানে ঢালাও মদত দিয়েছিল। এখন সেই আফগানিস্তানে আমেরিকার সেনাবাহিনীই বিপাকে পড়েছে। সেই সুযোগে জল মাপছে পুতিনের রাশিয়া।

আরও পড়ুন : ফিরে দেখা ২০১৯: এবছরের দেখা ৬টি সেরা বাংলা ছবির গল্প

১৯৭৯-৮৯ সালের আফগান যুদ্ধের সময় আমেরিকার প্রশাসন ভুলে গিয়েছিল, দরকার হলে চাবকে আফগানিস্তানের উপজাতি গোষ্ঠীগুলিকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা দরকার। আফগানিস্তান তখন রুশ ফৌজের কবলে থাকলেও সেখানকার তরুণ প্রজন্ম নিখরচায় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছিল, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠছিল, শিশুদের পোলিও খাওয়ানো হচ্ছিল, প্রসূতি মৃত্যু কমছিল, মেয়েরা বোরখা ছাড়াই পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছিল, এমনকী কাজের সুযোগও পাচ্ছিল। তারা শুধু রুজ-পমেটম মেখে ঘুরে বেড়াত না। রাশিয়ার প্রভাব খর্ব করতে আমেরিকার প্রশাসন তখন আফগানিস্তানে এমন এক শক্তিকে তোল্লাই দিয়েছিল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যাদের গোষ্ঠীতন্ত্র থেকে মধ্যযুগীয় অন্ধকার ঘোচেনি। মানসিক ভাবেও তাদের অনেকে ছিল বিকলাঙ্গ। কোনও কোনও উপজাতি গোষ্ঠীতে সমকামিতা এবং শিশুদের নিয়ে যৌন ক্রীড়া ছিল স্বাভাবিক জীবনের অঙ্গ। সৌদি আরব-পাকিস্তান ও লাল চিনকে নিয়ে আফগানিস্তানকে এক মারাত্মক যুদ্ধের চোরাবালিতে ফেলে আমেরিকার গেমপ্ল্যানাররা তাদের আরও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন।

এখনকার আফগানিস্তান সেই যুদ্ধেরই চেন রিঅ্যাকশন বলা চলে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া তার প্রভাব বলয় বিস্তার করবেই। পাকিস্তানের কাছে যা এক দুঃস্বপ্ন। সেই জেনারেল জিয়া উল-হকের সময় থেকে পাকিস্তানের রাশিয়াকে ভয়। আফগানিস্তানে রুশ সেনা ঢোকার পর জিয়া উল-হকের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানি সামরিক চক্রের ভয় ছিল, এর পর পাক-আফগান সীমান্তের মারকুটে পুশতুন গোষ্ঠীগুলিকে খেদিয়ে রাশিয়া ইসলামাবাদ-রাওয়ালপিন্ডির বিরুদ্ধেই লেলিয়ে দেবে। সেই জার পিটার দি গ্রেটের আমল থেকেই রাশিয়া মধ্য এশিয়া দখল করে ইরান এবং আজকের পাকিস্তান উপকূলের আরব সাগরে নামতে মরিয়া। শীতার্ত উত্তর কুরু বরাবরই গরম জলের আরব সাগরের পিয়াসী। সুতরাং আফগানিস্তান নিয়ে লড়াই সহজে থামবে না।

‘আমরা ইংরেজ-রুশ-মার্কিনদের হারিয়েছি’ বলে তালিবানি-ইসলামিক স্টেটের মতো উগ্র ধর্মান্ধরা যতই কোরান-হাদিশ আওড়াক, তারা ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট গেরিলা ফৌজ নয়। হো চি মিন-জেনারেল গিয়াপের মতো নেতৃশক্তির ঐতিহ্যও তাদের নেই। হো চি মিনের ভিয়েতনাম ছিল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক। তারা ধারাবাহিক ভাবে ঠান্ডা মাথায় ঔপনিবেশিক ফ্রান্স, অনুপ্রবেশকারী আমেরিকা এবং আগ্রাসী লাল চীনকে পিটিয়ে ঠান্ডা করেছে। কারণ, এই দেশগুলি ভিয়েতনামের জাতীয় সত্তায় হাত দিয়েছিল। আফগানিস্তানের মধ্যযুগীয় তালিবানি ও ইসলামিক স্টেটের সন্ত্রাসবাদী শক্তি কিন্তু ওসব জাতীয় সত্তা-টত্তা বোঝে না। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর তাদের উপর্যুপরি সাম্প্রতিক আক্রমণে আফগানিস্তানের বহু অসহায় নাগরিক নিহত হয়েছেন। এখন বিপাকে পড়ে আমেরিকার প্রশাসন আফগানিস্তান ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু অত সহজে তারা নিস্তার পাবে কি না সন্দেহ।