Date : 2024-04-24

ফিরে দেখা ২০১৯: বিদ্যাসাগরের বিগ্রহের ক্ষত নিয়েই নোবেল জয়ীর অভ্যর্থনা, কেমন আছে শহর?

কলকাতা:- এই শহরের বুকেই মহাজোটের ব্রিগেড ভরেছিল দেশের সংহতির বার্তা নিয়ে। আবার সেই শহরেই ট্রাম লাইনের ধারে আঁছড়ে ভাঙা হয়েছিল নবজাগরণের প্রাণপুরুষের আবক্ষ বিগ্রহ। রাজনীতির ঘোলাজলে কলঙ্কিত হয়েছিল শতাব্দী প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনা। কংক্রিটের জঙ্গলে মাঝে সুখ-দুঃখ একবছর কেমন কাটল শহরবাসীর? একনজরে বছর শেষে শহরের ১০টি সেরা খবরে নজর রাখলাম আমরা।

১.ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা:- চলতি বছরই ছিল পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০ বছর পূর্তির জন্মবার্ষিকী, আর সেই বছরেই শহরের বুকে ঘটে গেল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চূড়ান্ত অবমাননা। লোকসভা ভোটের প্রচারে এসেছিলেন অমিত শাহ সহ বিজেপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। লোকসভা ভোটের আগে ১৪ মে উত্তর কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে প্রচারে এসে বিক্ষোভের মুখে পড়েন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিজেপির প্রচার মিছিলকে কেন্দ্র করে স্লোগান দিতে থাকে ছাত্র সংগঠনের একাংশ। ঘটনাকে কেন্দ্র করে আচমকা দুই দলের মধ্যে ধুন্ধুমার কাণ্ড বেঁধে যায়। ভাঙচুর করা হয় বিদ্যাসাগর কলেজে স্থাপিত শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যাসাগরের মূর্তি। ঘটনায় তীব্র নিন্দার ঝড় ওঠে বিভিন্ন মহলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হন নেটিজেনরাও।প্রতিবাদে রাজপথে নামে সব রাজনৈতিক দল। মূর্তি ভাঙচুরের অভিযোগ অস্বীকার করে বিজেপি। পরিস্থিতি শান্ত হলে কলেজে ফের বিদ্যাসাগরের মূর্তি স্থাপন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

২.লোকসভা ভোট ২০১৯:- রাজনৈতিক দলের প্রচার মিছিল, সমাবেশে রাজ্যের অন্যান্য জেলার মতো কলকাতাও সরগরম হয়ে ওঠে। ১৯ জানুয়ারি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে ব্রিগেডে সমবেত হয় দেশে বিজেপি বিরোধী ২২টি রাজনৈতিক দল। মহাজোটের মঞ্চ থেকে বিজেপি বিরোধী লড়াই গড়ে তুলতে ডাক দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর কিছুদিন পরেই ব্রিগেডে বামফ্রন্টের সমাবেশ হয়। সমাবেশের মূল আকর্ষন কানহাইয়া কুমার শারীরিক অসুস্থতার কারণে যোগ দিতে পারেননি। লোকসভা ভোট উপলক্ষ্যে ব্রিগেডে সমাবেশ করেন বিজেপি। মঞ্চে মূল আকর্ষণ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিরোধী মহাজোটকে নিশানা করেন তিনি। লোকসভা ভোটের আগে সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রচার যুদ্ধের ময়দানে পরিনত হয়েছিল কলকাতা। শেষ পর্যন্ত দিল্লিতে অবশ্য নিজের মসনদ ধরেই রাখেন নরেন্দ্র মোদী। রাজ্যে মোট ১৮টি আসন পায় বিজেপি। তৃণমূল পায় ২২ টি আসন।

৩.ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো বিপর্যয়:- সুরঙ্গ পথে জল ঢুকে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুরঙ্গ তৈরির কাজে বড়সড় বিপর্যয় নেমে আসে। ৩১ আগস্ট সন্ধ্যে বেলা হঠাৎ-ই বৌবাজারের দূর্গা পিতুরী লেন ও শাঁখারিপাড়া লেনে সুরঙ্গ বিপর্যয়ের জেরে কম্পন সৃষ্টি হয়। কম্পনের জেরে ফাটল ধরে এলাকার একাধিক বাড়িতে। ভেঙে পড়তে থাকে একাধিক বাড়ি। আতঙ্কে ঘর-বাড়ি জিনিসপত্র রেখেই অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে বাস করতে থাকেন এলাকার বাসিন্দারা।

ক্রমশ ধ্বংসস্তূপের আকার ধারন করে বৌবাজার। ভূ-বিশেষজ্ঞরা জানান সরঙ্গ খোঁড়ার সময় গাফিলতির জেরেই এই বিপর্যয় হয়েছে। আঙুল ওঠে মেট্রো কর্তৃপক্ষের দিকেই। মেট্রো কর্তৃপক্ষ নিজেদের গাফিলতি মানতে নারাজ হলে জল গড়ায় কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত। সেখানে রাজ্য সরকারের চাপের মুখে ক্ষতিগ্রস্থদের৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয় মেট্রো কর্তৃপক্ষ।

৪.গড়িয়াহাট অগ্নিকাণ্ড:- ১৯ জানুয়ারি মধ্যরাত, ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ ভষ্মীভূত হয়ে যায় গড়িয়াহাটের ট্রেডার্স এসেম্বলি বিল্ডিং-এর ভিতরে থাকা সব কটি দোকান। দমকলের ২২ টি ইঞ্জিন এসে ঘটনাস্থলে প্রায় ১২টি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ক্ষতি হয় লক্ষাধিক টাকার। দমকলের তরফে অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসাবে শর্ট সার্কিট, বিল্ডিং-এর ধারে প্ল্যাকার্ড ও রাস্তার ধারে থাকা প্লাস্টিকের ত্রিপল খাটানো দোকান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানানো হয়। উঠে আসে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থার গাফিলতির চিত্র।

৫.জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি:- ১০ জুন এনআরএস হাসপাতালে রোগীর পরিবারের সদস্যদের কাছে চূড়ান্ত হেনস্থার শিকার হন কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার। ঘটনার জেরে চিকিৎসকদের বেনজির প্রতিবাদ ও লাগাতার কর্মবিরতির সাক্ষী হয়েছিল কলকাতা সহ গোটা রাজ্য। ক্রমশ জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির সঙ্গে যোগ দেন সিনিয়র ডাক্তাররাও। চিকিৎসা না পেয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন রোগীরা। এরপর মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে ১৭ জন জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে বৈঠক করে জুনিয়র ডাক্তারদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার আশ্বাস দেন। এরপর আন্দোলন প্রত্যাহার করেন জুনিয়র ডাক্তাররা।

৬.ডেঙ্গির প্রকোপ:- ডেঙ্গি আতঙ্ক থেকে বাঁচতে শহরে আগে থেকেই সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরপরেও শেষ রক্ষা মেলেনি। ডেঙ্গি নিয়ে নাজেহাল হতে হয় স্বাস্থ্য দফতরকে। ডেঙ্গি আক্রান্ত হতে শুরু করে শহর ও শহরতলির মানুষ। শহরের একাধিক হাসপাতালে বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গি নিয়ে শুরু হয় শাসক বিরোধী তরজা। সরকারের বিরুদ্ধে ডেঙ্গি নিয়ে তথ্য গোপন করার অভিযোগ ওঠে। সরকারি মতে মোট ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ৪৫ হাজার বলে জানানো হয়। এদিকে বিশেষজ্ঞদের মত, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপানা ও অন্যান্য কারণে ডেঙ্গি ক্রমশ চরিত্র পরিবর্তন করতে শুরু করেছে।

১২০ বছরের রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি দিল্লিতে, বর্ষবরণে ফের বৃষ্টি শহরে

৭.এটিএম জালিয়াতি:- গত বছর গোলপার্ক এই বছর যাদবপুর, ধারাবাহিক এটিএম জালিয়াতির জেরে আতঙ্ক ছড়ায় কলকাতায়। ওই এলাকার একাধিক এটিএম-এ বিভিন্ন ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও হয়ে যায় লক্ষাধিক টাকা। এটিএম জালিয়াতিতে এবারেও সামনে আসে স্কিমিং পদ্ধতি। একাধিক এটিএম-এ স্কিমিং মেশিন লাগিয়ে গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের তথ্য সংগ্রহ করে ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে তা বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর দিল্লিতে কয়েকটি এটিএম থেকে তোলা হয় টাকা। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, ঘটনার পিছনে রয়েছে কয়েকজন রোমানীয় হ্যাকারদের হাত। যদিও তার বাকি দুই সঙ্গী পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যায়।

ব্যর্থ দমকল, ২০ ঘন্টা পর কুয়ো মিস্ত্রি এসে উদ্ধার করল বাঁশদ্রোণীর যুবককে

৮.শিক্ষকদের অনশন:- লাগাতার শিক্ষক আন্দোলনে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে জুলাই মাসে বিকাশ ভবনের সামনে আন্দোলনে বসেন প্রাথমিক শিক্ষকরা। টানা ১৩ দিন অনশনের পর রাজ্য সরকারের তরফে বেতন বৃদ্ধি করা হয় প্রাথমিক শিক্ষকদের। এরপর পূর্ণ শিক্ষকের মর্যাদা প্রাপ্তি ও বেতন বৃদ্ধির সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের সামনে বিক্ষোভে বসেন তারা। বিক্ষোভের জেরে শিকেয় ওঠে পঠন-পাঠন। প্রথমে আন্দোলনরত শিক্ষকদের শোকজ করা হয়। শেষমেশ অবশ্য আন্দোলনকারীদের দাবি মানতে হয় শিক্ষামন্ত্রীকে।

৯.এনআরসি-সিএএ উত্তাপ:- নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি নিয়ে রাজনৈতিক ও অ-রাজনৈতিক প্রতিবাদের আঁচে উত্তপ্ত হয় কলকাতা। ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক মঞ্চ ও ডান-বাম রাজনৈতিক দল প্রতিবাদে সামিল হয়। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে কলকাতা ও হাওড়ার রাজপথে ১৬, ১৭ ও ১৮ তারিখ প্রতিবাদ মিছিল করেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সিএএ ও এনআরসি হতে দেওয়া হবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন। গণভোট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে বিতর্ক বাঁধে। পাল্টা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সমর্থনে জে পি নাড্ডার নেতৃত্বে মিছিল করে রাজ্য বিজেপি।

১০.অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল জয়:- বাঙালির গর্ব সারস্বত সাধনাতেই, সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে নোবেল পেলেন বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম মুম্বইতে হলেও তিনি বড় হয়ে উঠেছেন কলকাতাতেই। ২২ অক্টোবর রাতে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিমানবন্দরে পা রাখতেই তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হন অসংখ্য অনুরাগী। তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম ও মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। পরের দিন তাঁর বাসভবনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত হন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনীরা ও মোহনবাগানের সদস্যরা।