কলকাতা:- প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে কল্পতরুর জন্ম। কল্পতরু বোধিবৃক্ষ। অভীষ্ট ও ফলদায়ক বৃক্ষ। পুরাণ মতে, সমুদ্র মন্থনে এই বৃক্ষের আবির্ভাব। কোনও কোনও পুরাণ বলে, এটি ইন্দ্রলোকের সর্বকামনা-পূরণকারী দেবতরু। আবার কোনও কোনও দর্শন অনুসারে এই কল্পতরুর সঙ্গে ভগবানের স্ব ভাবের তুলনা করা হয়। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের শিষ্যরা কেন পয়লা জানুয়ারি দিনটিকে কল্পতরু দিবস বলেন?
ঠাকুর তখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন। শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছিল। নীলকণ্ঠের মতো দুনিয়ার পাপের ভার তিনি নিজের শরীরে বহন করছিলেন। উত্তর কলকাতার কাশীপুর উদ্যানবাটীতে শয্যাশায়ী অবস্থায় ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে দেখতে রোজই উপস্থিত হতেন শয়ে শয়ে ভক্ত।
পার্থিব জীবনের সময়সীমা ফুরিয়ে আসছিল। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর ভক্ত-শিষ্যদের বলতেন, ঈশ্বর বা পরমাত্মা হলেন কল্পতরু। তাঁর স্বরূপ অনন্ত।
সেই অনন্তের নিকটে সমর্পণ ও ভক্তি দ্বারা যে যা চাইবে সে তাই পাবে। তবে শ্রীরামকৃষ্ণদেব এও বলেছেন, যখন সাধন-ভজনের দ্বারা মন শুদ্ধ হয় তখন খুব সাবধানে মনের কামনা তাঁকে জানাতে হয়, কারণ কল্পতরুর নিকট প্রার্থনা করলে ভালো-মন্দ যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। ভালো-মন্দের জ্ঞান সঞ্চারিত করা যায় সাধনপথের মাধ্যমে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন তাঁর শিষ্যদের কাছে পরমজ্ঞানের প্রকাশ। লোকশিক্ষা ছিল তাঁর মহাজীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। একবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর অন্যতম ভক্ত ও বিশিষ্ট নাট্যকার গিরীশ ঘোষকে প্রশ্ন করেছিলেন অবতারত্ব সম্পর্কে। গিরীশ ঘোষ প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, “ব্যাস-বাল্মিকী যাঁর আদি-অন্তকে নিজেদের পরম জ্ঞানের পরিধিতে পরিমাপ করতে পারেননি, এই অধম গিরীশ তা কী করে পারবে?”
১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি এই পরম জীবন কল্পতরু পরমাত্মারূপে প্রকাশিত হয়েছিলেন তাঁর অগণিত ভক্তের সামনে। উদ্যানবাটীতে ঠাকুর কল্পতরু রূপে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসছিল। ভক্তদের উদ্দেশে সমাধিস্থ অবস্থায় ঠাকুর বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের কি আর বলবো, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হউক।’’ এই সময়ে ঠাকুর উপস্থিত গৃহী ভক্তদের বুক পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। সেই স্পর্শে অলৌকিকের ছোঁয়া অনুভব করেছিলেন উপস্থিত গৃহী ভক্ত ও অন্যান্য ঠাকুর-ঘনিষ্ঠরা। স্বীয় হৃদয়ে মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা অনুভব করেই যেন ঠাকুরের এই আশীর্বাদ— চিন্ময় চৈতন্য সত্তার জাগরণের আশিস। সেই থেকেই পয়লা জানুয়ারি দিনটি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ভক্তদের কাছে বিশেষ দিন। এই দিনে উদ্যানবাটী ও ঠাকুরের সাধনক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বিশেষ পুজোপাঠের আয়োজন করা হয়। এই দিনটি তাই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। দিনটিকে ‘কল্পতরু দিবস’ হিসেবে সবাই জানেন। কিন্তু এই প্রাপ্তি কোনও জাগতিকতায় আবদ্ধ নয়। এই প্রাপ্তি পরমার্থিক।