ওয়েব ডেস্ক : মুসলিম দুনিয়ায় নতুন করে ঝগড়া বাধছে। বাধার কথাও ছিল। একদিকে তুরস্কের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া ও কাতারকে নিয়ে সৌদি-বিরোধী জোট। আর এক দিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন বাদবাকি মুসলিম দুনিয়া। মাঝখান থেকে পাকিস্তান ফাঁপরে পড়েছে। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে একঘরে করবে বলে তারা মালয়েশিয়ায় মুসলিম দেশগুলির কনফারেন্স ডাকতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবের চাপে নিজেরাই সেখানে যোগ দিতে পারেনি। ওই কনফারেন্সে শিয়াপন্থী ইরানও আমন্ত্রিত হয়েছিল। সেটাই সৌদি আরবের রাগের অন্যতম কারণ। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন যে, পাকিস্তানের পীড়াপীড়িতে সৌদি আরবই কাশ্মীর ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলির অবস্থান কী হবে, সে ব্যাপারে সম্মেলন ডাকতে রাজি হয়েছে। যদিও সেই সম্মেলনের দিনক্ষণ এখনও স্থির হয়নি।
পাকিস্তানের এখন সত্যিই করুণ অবস্থা। ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) পাকিস্তানকে ব্ল্যাক লিস্ট করার জন্য আঁচিয়ে বসে আছে। গ্ল্যামার বয় ইমরান খান ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন হতে পারেন, কিন্তু পাকিস্তান এখনও আল্লাহ-আর্মি-আমেরিকা নির্ভর। আপাতত সেখানে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন সেদেশের সামরিক গুপ্তচর বাহিনী ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের প্রধান ফয়েজ হামিদ। যদিও আমেরিকার প্রশাসন এখন আর পাকিস্তানকে সহ্য করতে পারছে না। যে কারণে টেরর ফিনান্সিংকে কেন্দ্র করে তারা ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে মরিয়া। এই অবস্থায় পাকিস্তানের সেফটি ভালভ একমাত্র সৌদি আরব। তেলের বাণিজ্যের কারণেই যারা এক দিকে পশ্চিমা শক্তি, আর এক দিকে মুসলিম দুনিয়ার মধ্যে একটা সেতুর কাজ করতে পারে। আরব দুনিয়ার তেল আমেরিকান নৌবাহিনীর সমুদ্র শাসনের কাজে লাগে। সাদ্দাম হুসেন-শাসিত ইরাক দখলের লক্ষ্যই ছিল বিনামূল্যে তাদের তেলের ভাণ্ডার দখল করা। তাহলে সৌদি আরব সহ শেখশাহি তেল রফতানির ক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসনকে আর ব্ল্যাকমেল করতে পারত না। বিশ্বজুড়ে তেলের দামের ওঠাপড়াও নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। কিন্তু বুশ প্রশাসনের সেই উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত পূর্ণ হয়নি। পরবর্তী পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গিয়েছে।
সার্কের দুনিয়ায়, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই তিন দেশের মধ্যে সাধারণ ব্যাবসাদারদের টাকাকড়ির বেশিরভাগটাই হাওলার মাধ্যমে ঘুরপাক খায়। এটা বহু যুগের ব্যবস্থা। এই মুহূর্তে ভারতে পিঁয়াজের দামবৃদ্ধির ফলে তলায় তলায় পাকিস্তানের অর্থনীতিও টিঁকে যাচ্ছে কি না, তা কে বলতে পারে? মোগল যুগের হাওলা-হুন্ডির বন্দোবস্ত ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স-কে ঘোল খাইয়ে দিতে পারে। এফটিএএফ ‘তুলসীপাতা’ কিংবা ‘বেলপাতা’ চেনে? চেনে না। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সাধারণ বাজারের দোকানদাররা কিন্তু তা বিলক্ষণ চেনেন।
মুসলিম আরব দুনিয়ায় সব মিলিয়ে সাত-আটটি আধুনিক শিক্ষিত শাসকের দেশ ছিল। মিশর, আলজেরিয়া, মরক্কো, লিবিয়া আফ্রিকা মহাদেশে। আরব মরুভূমিতে ছিল সিরিয়া, জর্ডন আর ইরাক। কিন্তু আমেরিকার বিশ্ব-আধিপত্যের চালে এখন জর্ডন ছাড়া প্রায় সবারই লণ্ডভণ্ড দশা। ওদিকে রাশিয়া-বিরোধী সামরিক জোট নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো-ভুক্ত তুরস্ক অটোমান তুর্কিদের দেশ। অভিজাত তুর্কিরা মনেপ্রাণে আরব জাতির সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে। আরবদের তারা চোয়াড়ে-গাঁওয়ার বলে মনে করে। ঠিক যেমন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভিজাত অফিসারবর্গ এবং ধনী ব্যক্তিরা বাংলাদেশি মুসলমানদের অন্ত্যজ হিসাবেই ঘৃণা করেন। রুশ জারের ভাষায় অটোমান তুর্কি সম্রাট ছিলেন ‘সিক ম্যান অফ ইউরোপ’। সেই তকমা এখনও তুরস্কের গা থেকে মোছেনি। ন্যাটোভুক্ত হয়েও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান আর তাঁর জামাই আমেরিকার তোয়াক্কা না-করে ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া-র ঘাতকদের মদত দিয়েছিলেন। তাঁরাই এখন সৌদি-বিরোধী একটা মুসলিম রাষ্ট্রজোট গঠন করতে তৎপর। ‘মক্কার রক্ষক’ সৌদিদের তাঁরা আর পাত্তা দিতে চাইছেন না। এক নতুন পরিস্থিতি পাকছে।
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে এখন ভারতের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক অনেক ভালো। কুয়েত, বাহরিন আর ওমানের মতো দেশের সঙ্গে অবশ্য ভারতের সুসম্পর্ক অনেক দিনের। সরাসরি আরব শেখ দুনিয়ার কোনও দেশের সঙ্গেই ভারতের কখনও তিক্ত সম্পর্কের পরিস্থিতি ঘটেনি। ভারত যখন নির্জোট আন্দোলনের নেতৃভূমিকায় তখনও আমেরিকাভক্ত আরব শেখশাহির সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল। এখন সেই সম্পর্ক আরও মজবুত।
ইসলামে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কী কারণে আচম্বিতে ‘ইসলাম খতরে মে’ বলে হুংকার উঠবে তা মুসলিম দুনিয়ার জনসাধারণও জানে না। মাঝখান থেকে তারাই হাজারে হাজারে মরবে। কট্টরপন্থী মুসলিম সন্ত্রাসবাদের বলি তারাই বেশি সংখ্যায় হয়েছে। ইসলামিক স্টেটের তাণ্ডবেও তারাই পোকামাকড়ের মতো মরেছে। ইরানে আমেরিকাপন্থী শাহ-কে গদিচ্যুত করে সেদেশে শিক্ষিত গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি প্রথমে ক্ষমতায় বসে। কিন্তু ধর্মধ্বজী রক্তলোলুপ আয়াতোল্লাদের তা পছন্দ হয়নি। তার পর থেকে ইরানের মানুষের দুঃখও ঘোচেনি। দীর্ঘদিন পশ্চিম জার্মানিতে নির্বাসনে থাকার পর ধর্মের ধুয়ো তুলে আয়াতোল্লা খোমেইনি ইরানের বুনিয়াদি ক্ষমতায় চড়ে বসেন। ইরানের প্রগতিশীল সোশ্যালিস্ট ও কমিউনিস্টদের সপরিবারে নিধন করতে থাকে সেখানকার খোমেইনিপন্থী রিপাবলিকান গার্ড। ইরানের কমিউনিস্ট পার্টি তুদে পার্টির অনেক কর্মী-সমর্থক সেই সময় প্রাণে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন। ঠিক যেমন নাজিবুল্লার কাবুল সরকারের পতনের পর ভারতে পালিয়ে আসেন সেখানকার গোয়েন্দা বাহিনী ‘খাদ’-এর প্রধান। কোনও মুসলিম দেশে তাঁদের ঠাঁই হয়নি।
কট্টরপন্থী ইসলাম এবং কট্টরপন্থী হিন্দুত্বের হাঁকডাক একই ধরনের। এক দল সুন্নতে মহিমা খুঁজে পায়, আর এক দল টিকি-পৈতেয়। যদিও কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা এখনও মহম্মদ ইকবালের মতো ‘আন্দালুস হমারা’ গাইছে না কিংবা বেজিংয়ের হান কমিউনিস্ট শাসনকর্তাদের মতো সব মঙ্গোলয়েড জাতির পিতা বলে নিজেদের ঘোষণা করছে না, তবু সুযোগ পেলে তারাও যে পশ্চিমে গান্ধার থেকে পুবে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত সামরিক দখলদারি চালাবে, তা তাদের সাবেকি মতবাদ থেকেই বোঝা যায়। আলিগড়ি মওদুদি এবং আরএসএসের গোলওয়ালকর, উভয়েই বিয়ার-বিপ্লবী অ্যাডলফ হিটলারের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। অনুগামীদের ‘মেইন কাম্ফ’ পড়ার উপদেশ দিতেন। তুর্কি-সৌদি-পাকিস্তানি এদেরও হাবভাব তেমনই।
মালয়েশিয়া এক সময় আমেরিকান গিনিপিগ হিসাবেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই গিনিপিগ এখন আমেরিকার হাত ফসকে তুরস্কের আলখাল্লায়। মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আগে একটা মুসলিমদের অভ্যন্তরীণ ক্রুসেড বাধবে। তার পর হয়তো শুরু হবে ক্রিশ্চিয়ানডম বনাম ইসলামি দুনিয়ার লড়াই। সবই অবশ্য বুলিয়নের ওঠাপড়ার ওপর নির্ভর করছে।
এ রকম একটা সংকটে না আমেরিকা সহ পশ্চিমা দুনিয়ার স্যাক্স শপগুলো বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, এই ‘পবিত্র’ জায়গাগুলোয় ওইসব দেশের মানুষের বদলে শ্যাখেরা-পাগেরা-তিলকধারীরাই বেশি যায়!