কলকাতা: “যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী
উমা নাকি বড় কেঁদেছে।
আমি দেখেছি স্বপন, নারদ বচন,
উমা ‘মা’ ‘মা’ বলে কেঁদেছে।।”
শহর থেকে একটু দুরে নিঝুম দুপুরে মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে আপনার কানে এমন সুর ভেসে আসতেই পারে। কাশের বন, আকাশের রং চেনার প্রয়োজন নেই, এই সুরই আপনাকে বলে দেবে শরৎ এসেছে বাঙালির আঙিনায়। মহাকাব্য, রামচন্দ্র, রাবণবধ, দেবীতত্ত্বের বদলে হলুদ কোটা, নতুন শাড়ি, বরণডালা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। না, এ কোন বিয়ের মরসুম নয়, বরং ঠিক যেন সদ্য বিবাহিতা মেয়েটি ছেলে মেয়ে, তল্পি-তল্পা নিয়ে চারদিনের জন্য বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসার পালা। এখন অবশ্য দুর্গাপুজোর রীতি রেওয়াজ অনেক বদলেছে।
শহর জুড়ে থিমের রমরমা, কোটি কোটি টাকা বাজেটের বিজ্ঞাপনের ব্যানারে প্রতিযোগিতা। ঠাকুর দালান, ডাকের সাজ, ঝাড়বাতি, খিচুরি ভোগের গন্ধে এখনও সাবেকি আনায় টিকে আছে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলিতে। সারাবছর যেই দালানে চড়ুই পাখি, পায়রার নিত্য আনাগোনা, পিন পড়ার শব্দ যেখানে গমগম করে ওঠে, যে জানলা সকাল, বিকেল বন্ধ পড়ে থাকে, শরতের এই চারদিন সেই বাড়ির দরজায়ও বসানো হয় দ্বারঘট। সময়ের নিয়মে কেউ কেউ আরম্বর হারিয়েছেন দুর্গাপুজোর, আবার জাঁকজমকের দিক থেকে আধুনিকতার সঙ্গে তালমিলিয়ে চলেছেন কেউ কেউ। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বনেদি বাড়ির খসে পড়া পলেস্টরায় হাত রেখে চলুন আমার আপনার ঘরের মেয়ে দুগ্গার খোঁজ নিয়ে নি….
সে অনেক কাল আগের কথা, সবেমাত্র বিসর্জন সেরে বাড়ির কর্তা মশাই দুর্গাচরণ লাহা স্নান সেরে নেবেন বলে বসেছেন। এতো বড় পুজোর ঝক্কি সামলে তাতেও তাঁর শান্তি নেই। সামনে এক বালিকা কোত্থেকে এসে হাজির। সে আবার ভিক্ষা চেয়ে বসল! দুর্গাবাবুর স্নান খাওয়া মাথায়। নাছোড় বান্দা মেয়ে বায়না জুড়েছে “ভিক্ষা দাও ভিক্ষা দাও”। দুর্গাবাবুও রেগে আগুন, সারাদিন খাটাখাটনির শেষে তিরস্কার করে তাড়িয়ে দিলেন বালিকাকে! বিজয়া দশমীর দিনে কাউকে এভাবে তাড়িয়ে অবশ্য শান্তি পেলেন না তিনি। মনটা কেমন খচ্ খচ্ করতে লাগল। স্নান সেরে এসে দেখলেন, বাড়ির বিরাট সদর দরজা হাট করে খোলা। ঠাকুর, চাকর যে যেখানে আছেন তাদের হাঁক দিলেন দুর্গাবাবু। কিন্তু তারা এসে জানালেন কেউই দরজা খোলেননি, এমনকি কোন মেয়েকে ভিক্ষা করতে আসতে দেখেননি এই একই কথা সবাই বললেন। দুর্গাবাবু বুঝলেন এ নিশ্চয়ই অন্য কিছু। আসে পাশে খোঁজ নিয়েও হদিস পেলেন না কোন বালিকার। দুর্গাবাবু উপলব্ধি করলেন, এ মেয়ে স্বয়ং মা দুর্গা। হায়, হায় করে লাহা পরিবারের কর্তার তখন জীবন যায়। তবে অনুতাপে তাঁর জীবন যায়নি বরং তাঁর সময় থেকেই লাহাবাড়ির দুর্গাপুজো বিসর্জনে নতুন নিয়ম চালু হয়। বিসর্জনের সময় বন্ধ থাকে বাড়ির সব দরজা এবং জানালা। প্রধান দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা। তারপর বন্ধ হয়ে যায় সেই দ্বার। বাড়ি ফিরে কর্তা সদর দরজার বাইরে থেকে তিনবার চেঁচিয়ে প্রশ্ন করেন ‘ মা কি আছেন বাড়ির ভিতরে ?’
গৃহকর্ত্রী আড়াল থেকে উত্তর দেন‚ পরিবারিক দেবী জয় জয় মা ফিরে গেছেন ঠাকুরঘরে। আর মা দুর্গা রওনা হয়েছেন কৈলাসের পথে। এই উত্তর পেয়ে গৃহকর্তা প্রবেশ করেন বাড়িতে।
দুর্গাচরণের অন্তত তিন পুরুষ আগে লাহা বাড়িতে শুরু হয় দুর্গোৎসব। কেউ বলেন রাজীবলোচন লাহা‚ আবার কেউ বলেন তস্য পুত্র প্রাণকৃষ্ণ লাহা পত্তন করেছিলেন দুর্গাপুজোর। ২০০ থেকে ২৫০ বছর আগে। আজ‚ লাহা পরিবারের বহু শাখাপ্রশাখা। ছড়িয়ে আছে উত্তর কলকাতার নানা প্রান্তে। পালা করে দুর্গাপুজো হয় সবার বাড়িতে।সেও আজ থেকে প্রায় ১৬৫ বছর আগেকার কথা। এই বাড়ির পরবর্তী বংশধর রাজা প্রাণ কৃষ্ণলাহার আমলেই পূজার প্রসার ও চমক বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে এই পূজা লাহাদের পরিবারের সদস্য পালাদারদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। কলিকাতায় তাদের চারটি বাড়ি যথাক্রমেঃ
২ এ বিধান সরণী (রাজা কৃষ্টদাস লাহার বাড়ি),
১২১ নং মুক্তারাম বাবু স্ট্রীট (বাবু রামচরণ লাহার বাড়ি),
৫০এ কৈলাস বোস স্ট্রীট (বাবু জয়গবিন্দ লাহার বাড়ি),
১ নং বেচু চ্যাটারজী স্ট্রীট (বাবু পার্বতী চরণ লাহার বাড়ি)
এই পরিবারে দুর্গা প্রতিমা প্রতিবছর একই কাঠামোর উপর নির্মিত হয়। আশ্চর্য বিষয় আপনি এখানে এসে মা দুর্গার দশভূজা রূপ দেখবেন না। মা এখানে বৃষভারুঢ় মহাদেবের কোলে বসা, ছোট্ট গৌরীরূপে বিরাজমান থাকেন পুজোর চারদিন। সঙ্গে থাকে লহ্মী, স্বরস্বতী, কার্তিক ও গনেশ। এই মৃন্ময়ী প্রতিমার সম্মুখে রুপার সিংহাসনে লাহাদের ইষ্ট দেবী “জয়জয় মা”কে বসিয়ে পূজা করা হয়। দেবী মায়ের অষ্টধাতুর দশভুজা মূর্তি মহাসপ্তমীর সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুর দালানে মহা সমারোহে নিয়ে আসা হয় তারপর চারদিন ধরে চলে মহাসমারহে দুর্গোৎসব। মহাষ্টমীর দিন বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
এই বাড়ির বিশেষত্ব তাদের নিবেদিত ভোগে, যেখানে নানা রকমের নাড়ু যথাঃ চুম্বের নাড়ু, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুগের নাড়ু, ছোলার নাড়ু, বুটের নাড়ু যা কিনা তৈরি চালগুঁড়ো -নারকোল-গুড় দিয়ে, মুড়ির খোয়া, বেলা পিঠে, পান গজা, জিবে গজা, পাঁরাকি এবং লুচি, কচুরি, কুমড়োর ছক্কা, বেগুনি, ফুলুরি, পটল ভাজা, আলু ভাজা। বহু প্রকার পুরি লাড্ডু সহ ডাবের জল দ্বারা মাকে নৈবেদ্য সাজিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয়ে থাকে যা কিনা দেখবার মতো একটি আয়োজন।
এই পরিবারের একটি বিশেষ রীতি হোল “হরগৌরি”কে বাঁশের দোলায় চাপিয়ে বাহকরা কাঁধে করে গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন দিতে নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে হরগৌরী প্রস্থান করলেই সকল দরজা জানলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাড়ির কর্তা বিসর্জন পর্ব মিটিয়ে বাড়ি ফিরে বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করেন “ মা বাড়িতে আছেন?” তখন ভিতর থেকে গিন্নি উত্তর দেয় “হ্যাঁ মা(জয়জয় মা) বাড়িতে আছেন” তার পর দরজা খুলে দেওয়া হলে সকল সদস্য ভিতরে প্রবেশ করে। এই নিয়মের কারণ মা যে পরিবারের সকলকে ছেড়ে যান নি এই বিষয়টা যাতে মনে থাকে।