Date : 2024-04-29

হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান

হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান

শাহিনা ইয়াসমিন, রিপোর্টার : আর ডি বর্মণ, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং সুরেন্দ্র চক্রবর্তী। প্রথম দুজন যতটা বিখ্যাত, শেষের জন ততটা নন। যদিও সুরেন্দ্র চক্রবর্তী নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার প্রসারে স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন স্কুল। সেই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন সুরের জগতের দুই মহাতারকা। বালিগঞ্জের সেই স্কুল এখন মৃত্যুশয্যায়। কিন্তু কেন ? আর প্লাস নিউজের একটি বিশেষ রিপোর্ট।
স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী সবসময়ই আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। গর্বে বুক ভরে ওঠে প্রাক্তনীদের। কিন্তু শতবর্ষের সৌভাগ্য সব প্রতিষ্ঠানের মুকুট হয় না। বিবর্ণ এই স্কুল ভবন দেখুন। নাম সুরেন্দ্র চক্রবর্তী ইনস্টিটিউশন। প্রতিষ্ঠা ১৯৩৯ সালে। প্রায় আট দশকের ইতিহাস। ফিফটি সিক্স সি গরচা রোডের এই স্কুলই এখন মুখ ঢুকেছে। খসে পড়া চাঙড়, ইটের গা থেকে বেরিয়ে থাকা আগাছা, স্কুল ভবনের দৈন্যদশাকেই প্রকট করছে। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। বছর কুড়ি আগেও বেশ সাজানো গোছানো ছিল স্কুলটি। ছাত্র ও শিক্ষকের রোজকার উপস্থিতিতে গমগম করত স্কুল।
২০১৭ সালে বিনা নোটিসে পঠনপাঠন বন্ধ হয়ে যায় সুরেন্দ্র চক্রবর্তী ইনস্টিটিউশনে। স্কুলের ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেল স্কুল ভবনের পুনর্নির্মাণ হচ্ছে। যদি ভাবেন পুরনোকেই নতুন রূপ দেওয়া হচ্ছে তাহলে ভুল ভাবছেন। আসলে পুরনোকে চিরবিদায় জানানো হচ্ছে। পুরনোকে নিঃশব্দে অতীতের খাতায় পাঠানো হচ্ছে। একই জায়গায় মাথা তুলছে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। শতবর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া একটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান এভাবে হারিয়ে যাবে কেন, কী এমন হল যে স্কুলটির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন, তা ভাবিয়ে তোলে এই স্কুলেরই প্রাক্তনী শুভঙ্কর দেকে। স্কুল বাঁচাতে একাই লড়াইয়ে নেমেছেন। প্রিয় স্কুলকে বাঁচাতে দৌড়ঝাঁপ করে চলেছেন। উদদেশ্য একটাই, স্কুল যাতে ভাঙা না হয়, কিংবা সুরেন্দ্র চক্রবর্তী স্কুল যেন একইভাবে একই জায়গায় বেঁচে থাকে।


সুরেন্দ্র চক্রবর্তী ইনস্টিটিউশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সুরেন্দ্র চক্রবর্তী নিজেই। এই সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর পরিচয় জানতে গেলে ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে।
সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর জন্ম বাংলাদেশে। পরাধীন ভারতে তিনি কলকাতার বউবাজার মেট্রোপলিটন স্কুলে চাকরি করতেন। গুগলের উইকিপিডিয়া খুজঁলে তার সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানা যায় না। তবে তাঁর চারপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সবাই যশস্বী। সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর বন্ধুস্থানীয় ছিলেন ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। শ্যামাপ্রসাদই তাঁকে স্কুল গড়ার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ মেনেই ১৯৩৯ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন সুরেন্দ্র চক্রবর্তী। প্রথমে স্কুলের নাম ছিল এটি মিত্র। যা পরবর্তীকালে সুরেন্দ্র চক্রবর্তী ইনস্টিটিউশন নামে পরিবর্তিত হয়। সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর স্ত্রী মানসী দেবীর সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের বিশেষ সখ্যতা ছিল। সেই সূত্রে স্কুল গড়ে ওঠার সময় ঠাকুর পরিবারের পক্ষ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর পুত্র ছিলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতা কালীপদ চক্রবর্তী। বাংলা সিনেমায় বহু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কালীপদ চক্রবর্তী। তার বিখ্যাত ছায়াছবির মধ্যে অন্যতম বিন্দুর ছেলে। সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর অবর্তমানে কালীপদ চক্রবর্তী স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন। সুরেন্দ্র চক্রবর্তী ইনস্টিটিউশনেই পড়াশোনা করেছিলেন বাংলা গানের স্বর্ণযু গের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আর ডি বর্মণ। এই দুটো ভারি নামই যথেষ্ট স্কুলের অতীত গৌরব বোঝাতে। সেই স্কুল তবে হারিয়ে যাচ্ছে কেন।
শুভঙ্কর একা নন, তাঁর পাশে ছিলেন 86 নং ওয়ার্ডের প্রাক্তন বাম কাউন্সিলর দীপ্তি মুখার্জী। আর প্লাস নিউজ পৌঁছে গিয়েছিল দীপ্তিদেবীর কাছে। স্কুল বাঁচানোর লড়াইয়ে তিনি কি আজও আছেন ? প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দেন তিনি যথাস্বার্থ চেষ্টা করবে স্কুল বাঁচাতে।
এলাকার একটি প্রাচীন স্কুল হারিয়ে যাবে এমনটা মেনে নিতে পারেননি স্থানীয় বাসিন্দারাও। তারাও একটা পর্যায় পর্যন্ত লড়াই চালিয়েছেন যাতে স্কুলটা বাঁচে। কিন্তু স্কুলবাড়ির মালিক হাইকোর্টে জিতে যাওয়ার পরে তাঁদের আর কিছু করার ছিল না।
সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর কাছেই রয়েছে হার্টলে স্কুল। সেই হার্টলে স্কুলেরই বোর্ড পড়েছে সুরেন্দ্র চক্রবর্তীর গায়ে। অর্থাত্ আগামীদিনে এখানেই মাথা তুলবে নতুন প্রতিষ্ঠান। আর চিরতরে হারিয়ে যাবে গৌরীপ্রসন্ন, পঞ্চমের স্মৃতিধন্য স্কুল। না, এরপরেও টিমটিম করে হয়তো বেঁচে থাকবে নামটা। পাশেই আর একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলের এককোণে ঠাঁই হয়েছে সুরেন্দ্র চক্রবর্তী স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের। আপাতত সেখানেই তার ভূত-ভবিষ্যত্।