Date : 2024-04-26

অবাক পৃথিবীর পরিক্রমায় শতবর্ষে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

মেধাবি ছাত্র। পড়তে গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু মন টেকেনি। ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, তাঁর মনে তখন সুরের দোলা। মাঝপথেই ছাড়লেন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ। পরবর্তী সময়ে বাংলা তথা দেশ পেল কিংবদন্তি এক গায়ক ও সুরকারকে। যাঁর নামেই শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন অনুরাগীরা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। করোনা সঙ্কটে ব্যতিব্যস্ত, আতঙ্কিত, জীবন-জীবিকার দোলাচলে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙালি বোধহয় ঠিক খেয়ালই করে উঠতে পারেনি তাঁর জন্মশতবর্ষের।

১৯২০ সালের ২০ জুলাই। বারাণসীতে জন্ম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। পড়াশোনা কলকাতার ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। সেখানেই আলাপ হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। মনের মিল হতে দেরি হয়নি। বাকি জীবন সেই অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বে কখনই ছেদ পড়েনি। কবি সুভাষ আর গায়ক হেমন্ত দুইই বসন্তের রঙে রাঙিয়েছে বাংলাকে। পরিচয় হয় বিখ্যাত লেখক সন্তোষ কুমার ঘোষের সঙ্গে। বন্ধুত্বের এই বন্ধনও অমলিন ছিল। বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ও অনুপ্রেরণায় ১৯৩৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তাঁর প্রথম গান রেকর্ডিং করেন হেমন্ত। আমার গানেতে এলে নবরূপে চিরন্তনী। হেমন্তের সাঙ্গীতিক কেরিয়ারকে প্রথম দিকে দিশা দেন সেই সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক শৈলেশ দত্তগুপ্ত। গানের ক্ষেত্রে তরুণ হেমন্তের তখন মন কেড়ে নিয়েছেন পঙ্কজ মল্লিক। এমনকি কেউ কেউ তাঁকে ছোট পঙ্কজ বলেও ডাকতে শুরু করেন।

১৯৩৭ সালে সারা বাংলা জেনে যায় তাঁর উপস্থিতির কথা। এই বছরই কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত হয় হেমন্তের প্রথম নন-ফিল্ম ডিস্ক। যাতে দুটি গান ছিল। জানিতে যদি গো তুমি এবং বল গো বল মোরে। দুটিরই গীতিকার নরেশ্বর ভট্টাচার্য এবং সুর দিয়েছিলেন শৈলেশ দত্তগুপ্ত। এরপর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়ায় নিয়ম করে নন-ফিল্ম গান রেকর্ড করে গিয়েছিলেন হেমন্ত। ১৯৪০ সালে কমল দাশগুপ্তর সুরে এবং ফৈয়াজ হাসমির লেখায় প্রথম দুটি হিন্দি গান রেকর্ড করেন হেমন্ত। কিতনে দুখ ভুলায়া তুমনে এবং ও প্রীত নিভানেওয়ালি। ১৯৪১ সালে প্রথম কোনও বাংলা সিনেমায় শোনা গেল হেমন্তের গান। হরিপ্রসন্ন দাসের সুরে নিমাই সন্ন্যাস ছবিতে গলা দেন বছর কুড়ির হেমন্ত। ১৯৪৪ সালে নিজেরই সুরে প্রথম দুটি বাংলা গান রেকর্ড করেন হেমন্ত। দুটি গানই অসম্ভব জনপ্রিয় হয়। একটি গান ছিল কথা কয়ো নাকো শুধু শোনো। অন্য গানটি হল আমার বিরহ আকাশে প্রিয়া। দুটি গানই লিখেছিলেন অমিয় বাগচী। ১৯৪৪ সালে প্রথম কোনও হিন্দি সিনেমায় কন্ঠ দেন হেমন্ত। সিনেমার নাম ইরাদা। একই বছরে প্রথমবারের জন্য দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীতে কন্ঠ দেন হেমন্ত। আমার আর হবে না দেরি এবং কেন পান্থ এ চঞ্চলতা। যদিও এর আগে অল ইন্ডিয়া রেডিওয় একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন হেমন্ত। আমার মল্লিকা বনে। দুর্ভাগ্যের যে সেই গান বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্বে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন বা আইপিটিএ-র সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন হেমন্ত। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় গীতিকার ও সুরকার সলিল চৌধুরীর। ১৯৪৭ সালে সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে হেমন্ত গাইলেন গাঁয়ের বধূ। তেতাল্লিশের মন্বন্ত্বর নিয়ে সেই গান নাড়িয়ে দেয় গোটা পূর্ব ভারতকে। ঘরে-ঘরে পৌঁছে যায় দুটি নাম। হেমন্ত ও সলিল। পরবর্তী সময়েও সলিল চৌধুরীর সঙ্গে যুগলবন্দিতে বেশ কয়েকটি কালজয়ী গান গেয়েছিলেন হেমন্ত। রানার, অবাক পৃথিবী, দুরন্ত ঘূর্ণি।

এর পরের কয়েকটা বছর সুরের মায়াজালে ভারত জয় করলেন হেমন্ত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন হেমন্ত কুমার। নাগিন ছবির জন্য ১৯৫৬ সালে পেলেন সেরা সঙ্গীত পরিচালকের ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার। ১৯৭১ সালে নিমন্ত্রণ এবং ১৯৮৬ সালে লালন ফকির সিনেমার জন্য সেরা গায়কের ফিল্মফেয়ার পুরস্কারও পান হেমন্ত। ১৯৬২ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের বিচারে ৯ বার সেরা সঙ্গীত পরিচালকের সম্মান পান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এর মধ্যে ছিল স্বরলিপি, বিশ সাল বাদ (হিন্দি), পলাতক, মণিহার, বালিকা বধূ, ফুলেশ্বরী, ভালবাসা ভালবাসা, পথভোলা ও আগমন। ধন্যি মেয়ে, ফুলেশ্বরী ও প্রিয় বান্ধবী সিনেমার জন্য তিনবার সেরা গায়কের বিএফজেএ পুরস্কারও পান তিনি। ১৯৮৫ সালে তাঁকে ডিলিট সম্মানে ভূষিত করে বিশ্বভারতী। ১৯৮৬ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার।